Quantcast
Channel: বংপেন
Viewing all 1738 articles
Browse latest View live

দিবাকর মুন্সীর ফর্মুলা

$
0
0


*
ব্যাপারটা তেমন কঠিন নয়৷ হোমিওপ্যাথির চারটে বড়ি এক  গেলাস জলে মিশিয়ে দেওয়া। ব্যাস, কাজ শেষ। কাচের গেলাসটা শৌখিন কাঠের টেবিলের ওপর রাখা থাকবে, সকালের দিকটায় এ'ঘরে কেউ থাকবেও না। গেলাসের জলে সে বড়ি মিশিয়েই মনোহরের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার কথা। ঘরটা আদতে স্বনামধন্য লেখক অমল চৌধুরীর অফিসঘর। মনোহর বেরিয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা পর অমলবাবু  সেই ঘরে ঢুকবেন, নিজের টেবিলে বসবেন আর কিছুক্ষণের মাথায় নিশ্চয়ই সেই গেলাসে চুমুক দেবেন৷ 

সেক্রেটারি হিসেবে কাজটা করতে একদমই মন সরছিল না মনোহরের। কিন্তু এই সামান্য কাজের জন্য দিবাকর মুন্সীর আড়াই লাখটাকার অফারটা ফিরিয়ে দেওয়া গেলনা। অমল চৌধুরীর সেক্রেটারি হিসেবে দেড় বছর চাকরী করেও এত টাকা আয় করতে পারেনি সে। দিবাকর মুন্সী প্রকাশক, অমলবাবুর বেশির ভাগ বই উনিই ছাপেন। সম্প্রতি কী একটা ব্যাপার নিয়ে দু'জনের মধ্যে মন কষাকষি শুরু হয়েছিল বটে। কিন্তু দিবাকরবাবু যে আড়ালে ডেকে এমন একটা অফার দিয়ে বসবেন, সে'টা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মনোহর।

অবশ্য অমলবাবু মানুষ হিসেবে তেমন সুবিধের নন, পয়সাকড়ির ব্যাপারে বেশ চশমখোরই বলা চলে। কিন্তু তবু এমন গোলমেলে একটা কাজ করতে যে সে রাজী হবে সে'টা মনোহর আগে ভাবেনি। নিজের মধ্যে যে এত লোভ জমে আছে, সে'টা সে এর আগে টের পায়নি। দিবাকর মুন্সী অবশ্য বারবার আশ্বাস দিয়েছে যে অমল চৌধুরীকে প্রাণে মারবার কোনও ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া এই অমলবাবুর সেক্রেটারির চাকরীটাও দিবাকর মুন্সীই পাইয়ে দিয়েছিলেন।  তাছাড়া দিবাকরবাবু ঘোর ব্যবসায়ী মানুষ, তাঁর কথায় বিশ্বাস করারও কোনও কারণ নেই৷ তবে আগাম হাতে পাওয়া আড়াই লাখটাকার জন্য এ সামান্য কাজটুকু না করার মানে হয়।


**

- হ্যালো।

- হ্যালো। দিবাকর? নাহ্ হে। ক'দিন ধরে অনেক ঝগড়াঝাটি করলাম বটে তোমার সঙ্গে। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক৷ আমি আর প্রেমের গল্প লিখব না। বড্ড বেশি রিপিটেটিভ হয়ে যাচ্ছিল। এ'বারে পুজোয় আমি বরং একটা ভৌতিক উপন্যাস জমা দেব। প্রেমের দু'টো লেখা পড়েছিল। নিজেই সে লেখায় চোখ বুলিয়ে দেখে বুঝলাম; সেই একঘেয়ে বিরক্তিকর খাড়া বড়ি থোড। ফর্মুলায় পেয়ে বসলে যা হয় আর কী। কিন্তু আমার ঘোর কেটেছে৷ পাণ্ডুলিপি দু'টো পুড়িয়ে ফেলেছি। ভূতের উপন্যাসের একটা প্লটও মাথায় দানা বেঁধেছে। আজই লেখা শুরু করব।

- অমলদা, যখনই আপনি নতুন স্টাইল ধরেছেন, ফাটিয়ে দিয়েছেন। এ'বারেও তাই হবে। আমি নিশ্চিত।

- কিন্তু তোমার একটা সাহায্য লাগবে যে দিবাকর।

- এনিথিং ফর ইউ অমলদা। বলুন না।

- কোনও সেক্রেটারিই আমার অফিসে বছর দেড়েকের বেশি টিকছে না হে। আর সেক্রেটারি ছাড়া যে আমি অচল।

- সে কী, ওই যে ছেলেটি। কী নাম যেন.. মনোহর। বেশ চটপটে করিৎকর্মা ছোকরা বলে মনে হয়েছিল তো। সেও কেটে পড়েছে নাকি?

- এই নিয়ে টানা সাত নম্বর সেক্রেটারি না বলে কয়ে ডুব দিল হে। স্ট্রেঞ্জ ব্যাপারস্যাপার।  আর তুমি ছাড়া তো আমার গতি নেই। দাও দেখি একটা নতুন কাউকে খুঁজেপেতে।  

- ও নিয়ে আপনি ভাববেন না অমলদা। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

***

- এসো দিবাকর। এসো। 

- কেমন আছ ডাক্তার?

- যেমন দেখছ৷ দিব্যি।

- তোমার জন্য নিয়ে এলাম। এই দ্যাখো।

- নতুন পাণ্ডুলিপি? 

- অমল চৌধুরীর নতুন নভেল। পুজোর আগেই ছেপে বেরোবে। এই প্রথম ভদ্রলোল ভৌতিক প্লট নিয়ে লিখল। পড়ে দ্যাখো ডাক্তার, এক্কেবারে হাইক্লাস। কে বলবে কয়েকমাস আগেই গেঁজে যাওয়া প্রেমের প্লটে দিস্তে দিস্তে লিখে পাঠকের হাড় জ্বালাচ্ছিল। 

- বেশ পড়ে দেখব। তবে সেই তো ভিশিয়াস সাইকেল। এই ভূতের নভেল বেস্টসেলার হবে। তারপর একটানা যাই লিখবে শুধু ভূত। ততক্ষণ লিখে যাবে যতক্ষণ না পাঠক বমি করতে শুরু করেছে৷ 

- তা আর বলতে। গোয়েন্দা গল্প পাঠক খেলো মানে একটানা শুধু ডিটেকটিভ নভেল চালাবে। ঐতিহাসিক শুরু হলো তো বছরখানেক শুধু ঐতিহাসিক।  একবার প্রেমের প্লটে আটকা পড়ল তো শুধু গদগদ। আবার নামী লেখকের ইগোর ওজনও কম নয়৷ বিন্দুমাত্র নেগেটিভ ফীডব্যাক পেলেই বাবুর গোঁসা হয়ে যায়। 

- ফর্মুলা যে সাহিত্যের কী ক্ষতি করে। অথচ ফর্মুলা ফর্মুলা করেই অমলবাবুরা নষ্ট হয়ে যান, আর পাঠকদের প্রতিও অবিচার করেন।

- অগত্যা। ফর্মুলা ভাঙার দায় নিতে হয় আমার মত প্রকাশকদের৷ নেহাত তোমার ওই সাহিত্য ফর্মুলা ভাঙার জাদুবড়ি ছিল ডাক্তার। ওটির গুণেই তো বারবার এই অমল চৌধুরীকে খাদের ধার থেকে টেনে আনতে পারি। তবে যাদের দিয়ে অমলদাকে এ বড়ি গেলানো, সেই সেক্রেটারিগুলোর খাই বড় বেড়ে গেছে আজকাল।

- স্টাইলভাঙা লেখকের বই বেচে মুনাফাও তো কম হয়না তোমার দিবাকর। না হয় মাঝেমধ্যে অভাবী ছেলেমেয়েগুলোকে কিছু কিছু দিলে। যাকগে, শোনো। অমল চৌধুরী আগামী কিছুদিন ভূতের গল্প নিয়েই থাক। পরের বছর ওর স্টাইল ভাঙার জন্য নতুন বড়ি তৈরি করছি, এ'বার ওঁর ভাঁড়ার থেকে রম্যরচনা টেনে বের করব ভাবছি। 

- ব্রাভো ডাক্তার। ব্রাভো। এমনিতে অমলদার ভাষার জোর আছে৷ শুধু তোমার ওই স্টাইলভাঙার সাহস দেওয়া বড়ির সাপ্লাই থাকলেই, ভদ্রলোক অসাধ্যসাধন করতে পারবেন। 

-  আমার কমিশনটা ভুলো না যেন দিবাকর। 

মিস্টার সেনের থেরাপিস্ট

$
0
0


- এক্সকিউজ মী?

- বিলীভ মী। বানিয়ে বলছি না।

- আমি আপনার থেরাপিস্ট। ডেফিনিটলি আপনাকে অবিশ্বাস করছি না মিস্টার সেন। তবে...।

- তবে? ডাক্তার?

- না মানে...ব্যাপারটা বিষম খাওয়ার মতই।

- শুনেই আপনাকে বিষম খেতে হচ্ছে৷ তাহলে আমার কী অবস্থা সে'টা ভাবুন।

- আর একবার আমায় নিশ্চিত হতে দিন মিস্টার সেন৷ আপনি বলছেন আপনি আজ রাত্রে ঘুমোতে গেলেন। কিন্তু যেই সকালে আপনার ঘুম ভাঙবে সে'টা আগামীকালের সকাল নয়, গতকালের।

- এগজ্যাক্টলি। সঠিক বুঝেছেন। 

- আর এমনটা হচ্ছে গত মাসখানেক ধরে?

- রাইট ডাক্তার। আমি রোজ একদিন করে পিছিয়ে চলেছি। আমি আজ থেকে গতকালে পিছিয়ে যাচ্ছি। রোজ।

- কী সাংঘাতিক।

- আজ জুন মাসের নয় তারিখ, তাই তো? একমাস আগে আমি জুলাইয়ের নয়ে ছিলাম।

- অ।

- আপনি অবিশ্বাস করতে পারেন। আমি মাইন্ড করব না।

- বিপুলা এ পৃথিবী। এটসেটেরা এটসেটেরা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দায় আমার নয়। 

- আজকে ইন্ডিয়া জিম্বাবুয়ের ওয়েনডে হচ্ছে তো? 

- হচ্ছে।

- মোবাইলে লাইভ স্কোর চেক করুন দেখি ডাক্তার।

- গোটা সেশনের টাকা দিয়েছেন। যা বলবেন শুনব। যা করতে বলবে করব। এই যে...টসে জিতে ইন্ডিয়া ব্যাট করছে। বাইশ নম্বর ওভারে একশো বেয়াল্লিশ এক উইকেটে। কোহলি চালিয়ে খেলছে।

- বাইশ নম্বর ওভার তো। তেইশ নম্বর ওভারের প্রথম বল। একটা বিমার কোহলির কনুইয়ে লাগবে। রিটায়ার্ড হার্ট। 

- বলেন কী।

*মিনিট পাঁচেক পর*

- তুকতাক নাকি মিস্টার সেন? কোহলি বোধ হয় গোটা সিরিজের জন্য গেল।

- কোহলিকে নিয়ে ভাববেন না ডাক্তার। হালকা চোট। হাড় ভাঙেনি। পরের ম্যাচ খেলবে। সেঞ্চুরিও করবে।

- একটা খটকা লাগছে মিস্টার সেন। জুন মাসের নয় তারিখ তো আপনি ইতিমধ্যেই দেখেশুনে ফেলেছেন। এ চেম্বারের ঘটনাটাও তো..।

- ইয়েস। এ দিনটাও আমার দেখা।

- মিস্টার সেন। আপনাকে কাউন্সেল করা আমার কম্ম নয় যা বুঝছি।

- হাল ছাড়ছেন ডাক্তার?

- একটা কাজ করা যাক। আগামীকাল সকালে বরং আমি আপনাকে একটা ফোন করি। বা দেখাও করতে পারি। ব্যাপারটা ভীষণ ইন্ট্রিগিং। 

- আপনার আগামীকাল ডাক্তার? অর্থাৎ দশই জুন?

- ইয়েস।

- হ্যাঁ। দেখা করতেই পারেন। কিন্তু আপনি আজ ঘুমিয়ে কাল সকালবেলা দশই জুনে পৌঁছবেন অথচ আমি ফিরে যাব ন'তারিখে। অতএব  আপনার সঙ্গে আমার কথা হবে ভবিষ্যতের আমির সঙ্গে। দশই জুন আমার দেখা ও চাখা হয়ে গেছে। আমাদের দেখা হবে ওয়াইজ আউল কফি শপে।

- ওহ। সে'টাও আপনার জানা?

- ইয়েস ডাক্তার। আর এ'টাও জানা যে আপনার সঙ্গে আমার আগামী পরশু,  তরশু এবং তারপর একটানা প্রায় রোজ দেখা হবে। ওই একই কফিশপে।

- আপনি নিশ্চিত? আমাদের দেখা হবে?

- ডাক্তার ডাকটা বিরক্তিকর লাগছে। অনুপমা বলেই ডাকি?

- অ্যাস ইউ উইশ মিস্টার সেন।

- আমরা তুমিতে শিফট করব ঠিক সাত দিন পরে।

- হোয়াট?

- তুমিতে শিফট করব। ষোলোই জুন।

- মিস্টার সেন, ব্যাপারটা অস্বস্তিকর জায়গায় যাচ্ছে।

- প্রেম নিবেদনটা আমিই করব। বাইশে জুন। হুট করে বিয়ের জেদটা অবশ্য আপনার দিক থেকেই আসবে অনুপমা। 

- বাড়াবাড়ি হচ্ছে নাকি?

- আমার সিচুয়েশনটা আজ আপনার গোলমেলে ঠেকছে৷ কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝবেন কী গভীর সমস্যার আমি রয়েছি তেইশে জুন আপনি আমার হাত টেনে নিজের মুঠোর মধ্যে নেবেন অনুপমা। ওই, ওয়াইজ আউল কফি শপেই।

- মিস্টার সেন...!

- ষোলোই জুন থেকে তুমি বলার পাশাপাশি আমার নাম ধরে ডাকাও শুরু করবেন আপনি। মিস্টার সেনের বদলে অভিরূপ। 

- ব্যাপারটা পাগলামোর পাশাপাশি খুব আপত্তির জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে মিস্টার সেন। 

- অনুপমা। কোহলির ওই চোটের মতই হয়ত আমাদের সম্পর্কটাও ঠেকানো যাবেনা। জানি৷ তবু, ফিরে আসার সুযোগ পেয়ে একটা শেষ চেষ্টা করতে এলাম, যদি আপনাকে ঠেকানো যায়। আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবেসেছি অনুপমা। আর সেই ভালোবাসার জন্যই বলতে এলাম, আমার সঙ্গে আর দেখা করবেন না। প্লীজ না। জানি না এই ভাবে আমাদের তেসরা জুলাইয়ের হুটহাট করে সেরে ফেলা বিয়েটা আটকানো যাবে কিনা। কিন্তু নয়ই জুলাইয়ের পর থেকে আমি আর এগিয়ে দশই জুলাইয়ে যেতে পারিনি; এ'টা ভেবে একটা প্রবল অস্বস্তি হচ্ছে৷ ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। অনুপমা, প্লীজ অ্যাভয়েড মী। প্লীজ।

- দেখুন মিস্টার সেন। আমি আপনার থেরাপিস্ট না হলে এখুনি আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম। কিন্তু আপনার কথাগুলো মন দিয়ে শোনা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তা যতই গোলমেলে হোক না কেন। আর হ্যাঁ, আগামীকাল আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব এবং সে'টা করব পিওরলি অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্টে। না হয় সেই ওয়াইজ আউলের কফি শপেই দেখা করব কারণ আপনার বিটকেল ডিলিউসনগুলো ধুয়েমুছে সাফ করার দরকার আছে।

- ভুল করছেন অনুপমা। একটা বিরাট ভুল করছেন।

- কাল সন্ধ্যে সাতটায়।  ওয়াইজ আউল কফি শপ। আর এখন আপনি আসতে পারেন৷ আপনার সঙ্গে এখন আর বাড়তি কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

***

- অনুপমা।

- ইয়েস ডক্টর মিত্র? অভিরূপ কেমন আছে...?

- সরি। চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলাম না। ইট ওয়াজ আ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।  ইওর হাসব্যান্ড ইজ নো মোর।

- আজ জুলাইয়ের দশ তারিখ। অভিরূপ ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল ডাক্তার। আমায় সাবধানও করেছিল। কিন্তু আমিই...।

- আর ইউ ওকে অনুপমা? আমি জানি এ'টা কত বড় একটা শক...।

- অভিরূপ আমায় সাবধান করেছিল। বারবার। অথচ ওকে বিশ্বাস করতে চেয়েও পারিনি। আই ফেল ইন লাভ ডক্টর, আমি ভালোবেসেছিলাম।

গোল্লায়

$
0
0

- আমায় ডেকেছিলেন স্যার?

- এসো শ্যামল। এসো। বসো।

- জরুরী কিছু কী?

- ব্যাপারটা সিরিয়াস।

- বিট্টু স্কুলে কোনও গোলমাল করেছে?

- না। স্কুলে বা ক্লাসে কোনওরকমের গোলমাল করার ছেলে সে একেবারেই নয়। হি ইজ ভেরি ওয়েল বিহেভড। কথাবার্তায় নম্র। ইন ফ্যাক্ট, ওকে দেখে আমার তোমার কথা মনে পড়ে। ক্লাসে তুমিও ততটাই শান্তশিষ্টই ছিলে। সে'দিক থেকে স্বভাবগুলো সেও বাপের মতই পেয়েছে।

- তা'হলে কী ব্যাপার স্যার। আপনাকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

- ব্যাপারটা দুশ্চিন্তার তো বটেই শ্যামল।

- নেশাটেশা কিছু করছে নাকি বিট্টু? বিড়ি খেতে গিয়ে ধরা পড়েছে স্কুলে? ক্লাস ইলেভেনে উঠে শেষ পর্যন্ত এইসব শুরু করেছে?

- দু'টো বিড়ি ফুঁকলে লাংসের ক্ষতিটতি হয় বটে। বিড়ির চেয়ে ভালো কোয়ালিটির চানাচুরের নেশা বরং অনেক বেশি প্রগ্রেসিভ। কিন্তু না হে শ্যামল, সে'সব লঘু ব্যাপারে আমি গার্জেন কল করিনা। 

- তবে স্যার? একটু খুলে বলুন প্লীজ। ওই একটি মাত্র ছেলে। যা যুগ পড়েছে, আমি আর ওর মা মাঝেমধ্যেই নার্ভাস হয়ে পড়ি৷ গোল্লায় যাওয়ার এত কল চারদিকে..।

- এখনই সামাল না দিলে সে গোল্লায় যেতে পারে বটে। ব্যাপারটা খুব ক্রিটিকাল জায়গায় পৌঁছে গেছে দেখছি।

- ক্রিটিকাল?

- খুলেই বলি। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে আমার নাতনী ঝিমলিও তোমার ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। ঝিমিলির মা আজ সকালে এই চিঠিগুলো ওর স্কুলের ব্যাগ থেকে উদ্ধার করেছে।

- চিঠি?

- তোমার পুত্রের লেখা। 

- ঝিমলিকে লিখেছে?

- প্রেমপত্র। 

- রাস্কেল বিট্টে। স্কাউন্ড্রেল কোথাকার। মা ঠাকুমার আদরে একটা আস্ত বাঁদর তৈরী হয়েছে। ওকে যদি আমি চাবকে সিধে না করি তা'হলে আমার নাম শ্যামল চ্যাটার্জী নয়। ক্যালকুলাস প্র‍্যাক্টিস না করে ইডিয়টটা প্রেম শুরু করেছে? তাও আপনার নাতনীর সঙ্গে? ওর কান কেটে যদি মাদুলি করে ওর গলায় আজ না ঝুলিয়ে দিয়েছি..।

- শ্যামল, তোমার কান কেটে নেওয়া উচিৎ। 

- আজ্ঞে?  স্যার?

- প্রেমের চিঠি লিখেছে বেশ করেছে। 

- না মানে...ক্লাস ইলেভেনে...।

- ক্লাস ইলেভেনে ও প্রেমের চিঠি লিখবে না তো কি এই বয়সে আমি লিখব? এই তোমার শিক্ষা? প্রেম করছে বলে পেটাবে? তোমার শিক্ষক হিসেবে আমার আধঘণ্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ। 

- না মানে আমি তা বলতে চাইনি স্যার। কিন্তু এই যে আপনি বললেন ব্যাপারটা সিরিয়াস। বিট্টু গোল্লায় যেতে বসেছে..।

- গোল্লায় যেতে পারে। তবে আটকানোর সময় আছে। ছেলেটা যেহেতু প্রেমে সিনসিয়ার, ওকে পথে আনা সহজ।

- ব্যাপারটা যদি..স্যার...একটু খোলতাই করে...।

- ঝিমলিকে তোমার ছেলে বারোটা চিঠি লিখেছে। টোটাল সাতাশটা বানান ভুল, পার চিঠি ট্যু পয়েন্ট টু ফাইভ। গ্রামারে ভুলচুক আরও খান সতেরো। সবচেয়ে বড় কথা, গদগদ সব লাইন কোট করবি কর; তাই বলে ইলিয়ট আর টেনিসন গুলিয়ে ফেলবি? তোমার এবং তোমার ছেলের ইংরেজি মাস্টার হিসেবে বলছি; ছেলেকে সামলাও, ও ছেলে ভেসে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, পুরো দায়িত্ব তোমার কাঁধেই বা চাপাই কী করে। আমি যেহেতু ওকে পড়াই, এ লজ্জা আমারই সবচেয়ে বেশি। সে অর্থে ওর প্রেমপত্রের প্রতিটি ভুলের জন্য আমারও তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

- ছিঃ ছিঃ স্যার। এ আপনি কী বলছেন...।

- শোনো শ্যামল, আবারও বলি। প্রেমটা যেহেতু সিনসিয়ারলি করছে, ভাষার ভালোবাসাটা ও বুঝবে। 

- আজ্ঞে।

- যাক। এ'বার তুমি এসো। আর তোমার ছেলেকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। স্কুলে নয়, বাড়িতেই যেন আলাদা করে দেখা করে যায়।

- হ্যাঁ, সেই ভালো। আপনিই না হয় বিট্টুকে একটু ধমকেটমকে দেবেন'খন।

- ধমকানোর কাজটা আমি স্কুলেই সেরে নেব। ওকে বাড়িতে ডাকছি তোমার ব্যাপারে ওয়ার্ন করতে। যেমন তোমায় ডেকে আমি ওর ব্যাপারে সাবাধনা করে দিলাম।

- আমার ব্যাপারে ওকে...?

- সাবধান করে দেব। প্রেমের মত একটা জরুরী ব্যাপার সম্বন্ধে ওর বাপের ধ্যানধারণা কতটা রিগ্রেসিভ সে'টা ওর জানা দরকার। তবে কোনওদিন তোমার লেখায় বানান বা ব্যাকরণে ভুল দেখিনি। কবিতার লাইনও কোনওদিন ভুল কোট করেছ বলে মনে নেই। ভাষার প্রতি যেহেতু তোমার সিনসিয়ারিটি আছে, প্রেম ব্যাপারটাও একদিন তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। তবে এইবেলা তোমার ছেলেকে  সাবধান করে দিতেই হবে; যাতে প্রেমট্রেম না বুঝে তুমি গোল্লায় না যাও।

স্যুপ

$
0
0

- নুনের ডিবেটা এগিয়ে দেবেন প্লীজ?

- হুঁ।

- থ্যাঙ্ক ইউ। এ'খানে খাবারদাবার এত ব্ল্যান্ড..।

- হুঁ।

- অবশ্য, হসপিটালের ক্যাফেটেরিয়াতে এর চেয়ে বেশি কিছু আর আশা করিই বা কী করে বলুন।

- হুঁ।

- ইয়ে, আপনার স্যুপটা কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে..।

- হুঁ।

- শুনুন...এই যে...শুনছেন?

- হুঁ? আমায় বলছেন?

- অবভিয়াসলি।  বলছি, আপনার স্যুপটা সেই তখন থেকে নিয়ে বসে আছেন কিন্তু এক চামচও মুখে তোলেননি। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।

- ও। না, ঠিক আছে।

- সে কী। ঠিক আছে মানেটা কী। স্যুপের স্বাদের অর্ধেক তো টেম্পারেচারে। 

- ইচ্ছে নেই। থাক।

- তা'হলে নিলেন কেন? এ'দের ক্যাফেটেরিয়ায় জিনিসপত্রের যা দামটাম, দামী কফিশপকে হার মানায়।

- প্লীজ। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তবু বলছি। ডোন্ট মাইন্ড, আমার মনমেজাজটা ভালো নেই। কথাবার্তা বলতে চাইছিনা।

- আপনার পেশেন্টের সিচুয়েশন বুঝি..।

- আমি বরং পাশের টেবিলে গিয়ে বসছি।

- প্লীজ না, তারপর স্যুপের বাটি ফেলে একটা একাকার কাণ্ড হোক আর কী। 

- দেখুন মিস্টার...।

- দত্ত। অমিত দত্ত। আর আপনি?

- দেবজ্যোতি সিনহা। অমিতবাবু, প্লীজ স্পেয়ার মী।

- শিওর। শিওর।

- থ্যাঙ্ক ইউ।

- স্যুপটা?

- ওকে। খাচ্ছি। 

- নুনের ডিবেটা। এই যে। একটু ছড়িয়ে নিতে পারেন। যদি দরকার মনে হয় আর কী।

- না।

- আপনার ফ্যামিলির কেউ? ভর্তি? 

- বাবা। ক্রিটিকাল।

- আপনি..এক ছেলে?

- দাদা ক্যালিফোর্নিয়ায়। আসতে পারবে বলে মনে হয়না।

- স্যুপটা?

- খাচ্ছি তো।

- না মানে, মাইন্ড করবেন না। অমন মুখ ভেটকে খাচ্ছেন। গায়ে লাগবে বলে মনে হয়না।

- দিন নুনের ডিবেটা। সত্যিই বড্ড ব্ল্যান্ড।

- একটা স্যান্ডউইচ বলি? না না, এ বাবা। আমি কিন্তু ইন্ট্রুড করতে চাইনি।

- আসলে, ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছি। বাবা আমাদের দুই ভাইকে যে কী'ভাবে আগলে বড় করেছেন...। ওকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে খুব..। 

- উনি কি...আইসিইউতে?

- হ্যাঁ। ডাক্তাররাও তেমন ভরসা দিতে পারছেন না..।

- আপনার স্যুপটা ঠাণ্ডাই হয়ে গেছে। একটা স্যান্ডউইচ হলে বরং..।

- স্যান্ডউইচ আমার গলা দিয়ে নামবে না। স্যুপটাই খেয়ে নিচ্ছি বরং।

- আচ্ছা।

- দাদাটা থাকলে অন্তত..। ওকে এত মিস করছি...।

- স্যান্ডউইচটা? বলি? আমি শেয়ার করে নেব না হয় একটু। ডোন্ট মাইন্ড, গায়ে পড়াটা আমার স্বভাব। আপনি স্যুপটাকে জাস্টিফাই করতে পারছেন না।

- আপনি নিননা স্যান্ডউইচ। 

- বয়স হয়েছে তো। ইচ্ছে থাকলেও এ'দের ডাবল ডেকার নিজে পুরোটা ম্যানেজ করতে পারব বলে মনে হয় না। আপনি যদি একটা স্লাইস অন্তত..।

- আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমায় তুমি বলতে পারেন। আর স্যান্ডউইচ বলুন না। আমি নেব না হয় এক স্লাইস। তবে..আমি পে করব।

- সে তো ভালো কথা।

- আপনার পেশেন্ট?

- আইসিইউতে নেই।

- যাক। আপনার বাড়ির কেউ?

- আমার পেশেন্ট তুমি।

- এক্সকিউজ মী?

- সকালে হসপিটালের বাইরে চায়ের দোকানে তোমায় দেখলাম চা টোস্ট নিলে। খেলে না। লাঞ্চের সময় দেখলাম এ'খানে এসে রুটি সবজি নিলে এবং নষ্ট করলে। নিশ্চিত ছিলাম সন্ধ্যের ভিজিটিং আওয়ার শুরু হওয়ার আগে ফের আসবে এ'খানে। যাক, স্যুপখুনটা অন্তত রুখতে পারলাম।

- আপনি আমায় ফলো করছেন?

- রোজই করি। কাউকে না কাউকে। আমার সংসারে কেউ নেই। রিটায়ার করেছি। এখন হাসপাতাল টু হাসপাতাল ঘুরে রোজ তোমার মত কারুর পিছনে পড়ে যাই। তাকে খাইয়ে তবে স্বস্তি। স্যুপটা খেয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত করেছ। স্যান্ডউইচের একটা স্লাইস নিলে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হই। আরে! পেশেন্টের হয়ে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে স্ট্রেন্থ লাগে তো। না খেলে চলবে কেন!

- আপনি কি পাগল?

- পাগল? হতে পারি। নিজের সন্তানকে এক সময় এই হাসপাতালেরই আইসিইউতে দেখেছি। সেই সন্তানের শোকে পাথর হয়ে পড়া স্ত্রীকে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। নিজেকে সুস্থ বলে আর কী'ভাবে দাবী করতে পারি বলো। তবে এই হাসপাতালের সামনের চায়ের দোকান বা এই ক্যান্টিনে এসে মাঝেমধ্যে বিমর্ষ মানুষের মুখে দু'এক গ্রাস খাবার তুলে দিতে পারি বইকি। কেউ নরম সুরে বললে শোনে, কাউকে ধমক দিতে হয় আর তোমার মত টেঁটিয়াকে মহাভারত শুনিয়ে পথে আনতে হয়। যত অন্ধকারই হোক, কান ধরে খাইয়ে দেওয়া গার্জেনের দরকার সবারই পড়ে। আমারও পড়বে কোনওদিন। সে'দিন আমি কোনও পাগলের দেখা পাব কিনা কে জানে।

- দু'টো স্যান্ডউইচ বলি বরং। একটা নিয়ে ভাগাভাগি করে খাওয়ার কোনও মানে হয়না।

ভ্যাক্সিন

$
0
0

- ভাই হবস। বুকের ভিতরটা কেমন...।

- কেমন?

- হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়।

- অ।

- কেমন যেন..অস্বস্তি।

- মনখারাপ ভাই ক্যালভিন?

- ঠিক তা নয়।

- মনকেমন?

- হবে হয়ত।

- বলো স্পেসম্যান স্পিফ। বলো।

-  তুমি আছো তাই বাঁচোয়া।

- আমি তো শুধু শুনি। কিছুই তো করিনা।

- সেটুকুই তো ভ্যাক্সিন। 

সারকাজমে বঙ্কিম

$
0
0

- বুঝলে দাদা, বড় মুশকিলে পড়েছি।

- মুশকিল? সিরিয়াস কিছু?

- রীতিমতো। 

- কী'রকম?

- আমি সারকাজমে বঙ্কিম; এ ধারণা নিয়ে এতদিন দিব্যি সুখে ছিলাম।

- এই কনফিডেন্সিটাই তো চাই ভায়া। এ'টাই তো চাই।

- কিন্তু কনফিডেন্সটায় সামান্য খোঁচা লাগল যে।

-  সে কী! কনফিডেন্সে খোঁচা? হাউ?

-  এইত্তো। গতকাল ভোরের দিকের স্বপ্নে খোশমেজাজে অন্যের নিন্দেমন্দ করছিলাম। এমন সময় স্বপ্নের ফ্লো নষ্ট করে বঙ্কিমবাবু এসে বলললেন; আমার সারকাজম বাকি কীবোর্ডের মাধ্যমে অনবরত ইটপাটকেল ছোঁড়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

- এ'কথা বঙ্কিম বললে?

- নিজের কানে শুনেছি। আর মাইন্ড ইউ, স্বপ্নটা কিন্তু ভোরের..।

- বঙ্কিমটা একটা ইডিয়ট।

- আস্ত ইডিয়ট, তাই না? তাই হবে। ঠিক বলেছ৷

যুদ্ধযাত্রা

$
0
0

- সরাইখানায় নতুন বলে মালুম হচ্ছে?

- হুঁ।

- আমার নাম কার্লোস। বসি এ'খানে?

- আমি আন্দ্রে।

- বয়সে তো তুমি আমার খুড়োর বয়সী গো। তা, একটু না হয় আবদার নিয়েই বলি। এক গেলাস বিয়ার খাওয়াও না।

- বেশ তো..।

- বাঁচালে কার্লোস খুড়ো৷ গলা এক্কেবারে শুকিয়ে কাঠ। এই যে ভায়া, দু'টো বিয়ার এই টেবিলে।

- একটাই বলো না হয়।

- ও মা। তুমি খাবে না নাকি? 

- নাহ্।

- তা'হলে তাই হোক। তবে দু'টো বিয়ার আসছে যখন আসুক না। আমি না হয় দু'টোই...। কিন্তু ইয়ে খুড়ো...তাই বলে আমার পানপাত্রটি খালি হওয়ার আগে কেটে পড়ো না যেন। সন্ধ্যের মেজাজটি তা'তে নষ্ট হবে। 

- বেশ।

- খুড়ো, তুমি বড় অল্প কথার মানুষ দেখছি। 

- তুমি একাই তো দিব্যি আড্ডা জমিয়েছ। আমার আর বেশি কথায় কাজ কী বলো।

- শোনো খুড়ো, চুপ করে বসে থাকলে কিন্তু কিছু হবেনা। এ'বার গর্জে না উঠলেই নয়।

- গর্জন?

- গর্জন। এক্কেবারে হালুম। দেশের ঘাড়ে যুদ্ধ এসে পড়েছে আর আমরা মিউমিউ করব; এ'টা তো মেনে নেওয়া যায়না খুড়ো। 

- তা তো বটেই।

- যাক, বিয়ার এসেছে। 

- গলা শুকিয়ে গেছে বলছিলে। চুমুক দাও।

- চিয়ার্স। আহ্। বুঝলে খুড়ো, এ'বার কিন্তু আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিককে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

- ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? কাদের ওপর?

- ও মা! হাড়হারামি দেশ সিলডাভিয়া আমাদের আক্রমণ করে বসল। এ'বার আমাদের প্রত্যেককে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। পড়তে হবেই। কুত্তার বাচ্চা সিলিডাভিয়ানদের দেখলেই কচুকাটা করতে হবে।

- দেশের হয়ে বুক চিতিয়ে লড়তে পারে, এমন নাগরিকই তো  দরকার।

- দেশের ওপর এমন আক্রমণ হচ্ছে ভাবলেই চোখ ভিজে আসে গো খুড়ো। এই আমার চোখের দিকে চেয়ে দ্যাখো! দ্যাখো। বুঝছ দুঃখটা?

- আহা আন্দ্রে। সত্যিই কেঁদে ফেলবে নাকি?

- কাঁদব না কেন খুড়ো? কেঁদে ভাসাব না কেন? দেশের ওপর এমন অন্যায় আঘাত হানার আগে শুয়োরের বাচ্চা সিলডাভিয়ানগুলো আমায় গুলি করে মেরে ফেললো না কেন।

- গুলি? খেতে চাইছ?

- মরতে ভয় পাই ভেবেছ খুড়ো? দেশের জন্য অমন কয়েক হাজার গুলি খাওয়ার যন্ত্রণা আমি হেসে হজম করতে পারব। 

- বাহ্।

- বুঝলে খুড়ো। দেশের চেয়ে বড় কিছু হয়না। কবিরা কি সাধে বলেছেন যে দেশ আদতে যে নিজের মায়েরই মত। তার ওপর এমন অশ্লীল আক্রমণ..আমি সন্তান হয়ে মেনে নেব কী করে?.

- হ্যাঁ। যুদ্ধের অবস্থা বেশ ভয়াবহ।

- কিন্তু তুমি দেখো খুড়ো, আমরা জিতবই। প্রয়োজনে আমার এই লাঠিটা নিয়ে সীমানায় গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেব। সিলডাভিয়ানদের তলোয়ারের ঘায়ে প্রাণ দিতে হলে দেব। দেশের জন্য দেব।

- দেবে বৈকি।

- জানো আমি কী চাই খুড়ো?

- কী চাও আন্দ্রে?

- আমি চাই আমাদের সৈন্যরা সীমান্তে আটক না।থেকে সিলডাভিয়ায় ঢুকে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিক। তা'হলেই হারামজাদারা বুঝুবে কত ধানে কত চাল..।

- ও'দের বোঝানো দরকার,তাই না?

- আলবাত দরকার। আর এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিৎ রাজামশাইয়ের কাছে আবেদন করা যাতে সিলডাভিয়াকে এইবেলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

- যুদ্ধ তো সিলডাভিয়াও করবে।

- আমরা কি যুদ্ধকে ডরাই ভেবেছ খুড়ো? আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে...টগবগ করে!

- যাবে? যুদ্ধে?

- আমায় কিছু বললে নাকি খুড়ো? বড় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম...ঠিক শুনতে পাইনি।

- যুদ্ধে যাবে?

- যুদ্ধে? সীমান্তে?

- কাল সকালেই আমায় সীমান্তের দিকে যেতে হবে। সে'খানকার সেনাছাউনিতে একটা জরুরী কাজ আছে। তোমার মত জোয়ান ছোকরাকে সহজেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়ে নেবে কিন্তু আন্দ্রে। যাবে আমার সঙ্গে?

- ইয়ে, যাওয়ার তো বড় ইচ্ছে। বড় ইচ্ছে। কিন্তু..।

- কিন্তু?

- আমার একটা মুদীর দোকান আছে হে খুড়ো৷ দেশের জন্য যতই বুক ফেটে যাক; দোকানটা বন্ধ রাখা একদমই উচিৎ হবে না। তাছাড়া সবাই ড্যাংড্যাং করে যুদ্ধ করতে গেলেই তো হবে না, অর্থনীতির ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে।

- এই অসময়ে, তোমার মত গুণী মানুষরা যদি সীমানায় গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় আন্দ্রে...তবেই তো দেশের ও দশের সাহস বাড়বে।

- বটেই তো বটেই তো। তবে ইয়ে খুড়ো, আমার না আবার ছোটবেলা থেকেই একটু সর্দির ধাত আছে৷ খোলা হাওয়া বুকে লাগলেই কফ বসে সে এক একাকার কাণ্ড৷ তাছাড়া মা আচার শুকোতে দিচ্ছে রোজ দুপুরে, সেই আচারের পাত্রগুলো বিকেলবেলার দিকে ঘরে ঢোকানোর দায়িত্বও আমার। বাড়িছাড়া হলে মা যা বকুনি দেবে না খুড়ো...এক্কেবারে খতরনাক মহিলা।

- বেশ।

- তা খুড়ো, সেনাছাউনিতে আবার তোমার কী কাজ?

- আমার একমাত্র পুত্র আলেকজান্ডার। সে গতকাল আমাদের সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যায়। খোকার দেহটাকে নিয়ে বাড়ি ফেরা দরকার, তার মা পথ চেয়ে বসে রয়েছে যে।

গর্বোদ্ধত

$
0
0
কলকাতা ও বাংলা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। আমাদের সংস্কৃতি,  আমাদের ঐতিহ্য ইত্যাদি। আবার আমাদের খবরের চ্যানেলগুলোকে চীনের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে শহরের চায়না টাউনে ছুটে যেতে হয় সে'খানকার চীনে রেস্তোরাঁর মালিকদের প্রশ্ন করতে;
"চীনের আক্রমণ সম্বন্ধে আপনারা কী ভাবছেন"?

আমাদেরই সহনাগরিকরা যে বিদেশী আক্রমণ বরদাস্ত করছেন না; সে'টাও খবর। সে খবর আমরা কনজিউম করি। সে আশ্বাস টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে ভেসে না এলে আমরা স্বস্তি পাইনা। 

আমাদের গর্বের শেষ নেই।

ভিক্টোরিয়ার স্বপ্ন

$
0
0

- ভিক্টোরিয়া?

- ভিক্টোরিয়া। স্বপ্নে একেবারে জ্বলজ্বল করছিল।

- একে করোনায় গৃহবন্দী মনমেজাজ খারাপ। সবই বুঝি। কিন্তু তাই বলে স্বপ্নেও ক্লীশে ঘষবে গো?

- দ্যাখো বউ, হতে পারে ক্লীশে। তবু স্বপ্নটি জেনুইন৷

- জেনুইন?

- ছোটবেলার সুবাস নাকে এলো৷ এক্কেবারে মনকাড়া অ্যাফেয়ার।

- স্বপ্নে? সুবাস?

- তবে আর বলছি কেন। সে সুবাস রীতিমতো নাকের ভিতর সুড়সুড় করে গেল।

- তা সেই সুবাসের নেচারটা ঠিক কীরকম?

- ওই যে। বাগানের বেঞ্চিতে বসে  স্টিলের টিফিন বাক্স খুলে লুচি আলুভাজা বের করার যে মনমাতানো গন্ধ? সেইটা।

- হবে না।

- ও মা। কী হবে না?

- এ'সব স্বপ্নের বাহার আমি বুঝি না ভেবেছ? রাতে চিকেন স্টু আর ভাত। গিলতে হয় গেলো, নয়ত ভিক্টোরিয়ার বেঞ্চিতে গিয়ে ছেলেবেলার কথা মনে করে বাতাস পকোড়া খাওগে।

- অমন কড়া সুরে বলতে নেই বউ৷ আলু আমি ভাজব। ময়দাও আমিই মাখব৷ তুমি শুধু বেলে দিও। গতজন্মে কী ভয়ানক পাপই না করে এসেছি; আমার হাতে বেলা লুচি কিছুতেই ছাই ফুলতে চায় না। সে এক ট্র‍্যাভেস্টি। 

- উফফ। যত্তসব। একে লকডাউন তার ওপর যত আজেবাজে নেকু স্বপ্ন। প্রাণ ওষ্ঠাগত। 

- শোনো বউ, রিয়েল এস্টেট যে'ভাবে ক্র‍্যাশ করছে তা'তে  চার হাজার টাকা পার স্কোয়্যার ফিট দরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের এক চিলতে বারান্দা বিক্রি হলে আশ্চর্য হব না। আর সে সু্যোগ এলেই পিএফ ভেঙে তোমার জন্য ভিক্টোরিয়ার আড়াইশো স্কোয়্যার ফিট বারান্দা কিনে নেব। প্রতি রোব্বার বিকেলে আমরা সে'খানে বসে মুড়িমাখা খেতে খেতে তাস খেলব। 

- শোনো..তুমি ময়দা মাখো গিয়ে। আমি বেলে দেব।

- অহো বউ, তোমারেই করিয়াছি জীবনের ভিক্টোরিয়া।

কচুরীয়

$
0
0

১। বারো কি বাহাত্তর বছর আগের ব্যাপার।

২। গল যোদ্ধা লেভেলের অদম্য বয়সের দু'জন মানুষ।

৩। ময়দান ঘেঁষা হাঁটাহাঁটি আর পার্ক স্ট্রীটের রেস্টুরেন্ট রোমাঞ্চ বাদ দিয়ে তারা দেখা করেছিল দক্ষিণেশ্বরে। 

৪। সে ডেট-য়ে তাদের টেনে নিয়ে গেছিল হিংয়ের কচুরী। 

৫। এটাসেটামিক্স গোছের কচুরী দাদার হাত থেকে ভক্তিভরে তারা গ্রহণ করেছিল কচুরীর প্লেট আর ডালের বাটি। 

৬। একজন অপরের ডালের বাটিতে নিজের কচুরীর টুকরোটি ডুবিয়ে নেওয়ায়র মনোমালিন্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল কল্পতরু কচুরীদাদার আশ্বাস; "ডাল যত চাইবে পাবে, চিন্তা কীসের গো"। 

৭। সে হিংয়ের কচুরীর সুবাসে "আবার কবে দেখা হবে"ছিল; পরের প্রতিটি 'আবার কবে দেখা হবে"তে সে সুবাস ঘুরে ফিরে এসেছে। 

৮। প্রেমে হাবুডুবুফিকেশনের জন্য কি উত্তম-সুচিত্রা মাখানো 'এই পথ যদি না শেষ হয়'গোছের সুর জরুরী?  আদৌ নয়৷ কোয়ালিটি হিংয়ের কচুরীর স্পর্শ পেলে "সকলই তোমারই ইচ্ছে'তেই এস্পারওস্পার সম্ভব। মাইরি, সম্ভব; সেই দু'জন মানুষ প্রসেসটা টের পেয়েছিল; ওই বারো কি বাহাত্তর বছর আগে।

খুনখারাপি আর মামলেট

$
0
0

 - ব্রাদার, একটু অপেক্ষা করা যায় না?

- চোপ শালা। বন্দুকের ছ'টা গুলিই গেঁথে দেব মুণ্ডুতে..।

- অপচয় করবে কেন? একটা গুলিতে যদি খেলখতম করা যায়, তা'হলে বাকি পাঁচটা নষ্ট করার কোনও মানে হয়?

- এই! মাইরি! বলছি...।

- ভাতের দানা হোক কি বুলেট। অপচয় দেখলেই বুকে বড় বাজে।

- কপালে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে রেখেছি, তারপরেও এত ফটরফটর? আচ্ছা ত্যাঁদড় মাল মাইরি।

-  আমার বাপ, আমার অঙ্কের মাস্টার, আমার মায়া। সবার মুখেই আজীবন ওই এক কথা শুনেছি। আমি নাকি রাম-ত্যাঁদড়। তা ও'টাকে আমি কম্পলিমেন্ট হিসেবেই ট্রীট করি বুঝলে হে। কোনও কিছু একটু না বাজিয়ে আমি এক্সেপ্ট করতে পারিনি কোনওদিনই। 

- মায়া কে?

- আমার স্ত্রী। ওই যে..।

- কে? কে? কে ওখানে?

- আরে ধুর ধুর। এই কলজে নিয়ে মার্ডার করতে নেমেছ? লাশ নামানো কি অতই সস্তা? ও'দিকে কেউ নেই হে। ওই দেওয়ালের ছবিটা দ্যাখো। ওই যে। মায়ার ছবি। সে ফাঁকি দিয়ে সুট্ করে সরে পড়েছে অনেক আগে। মায়ার মত মেয়ে হয় না গো ব্রাদার। এই যে তুমি অসময়ে এলে, শুকনো মুখে তোমার সে কিছুতেই বসে থাকতে দিত না। ঘরে আর কিছু না থাকলে দু'টো ডিম অন্তত চট করে ভেজে দিত। আর কফি। আহা, মায়ার হাতের কফি ভায়া..প্রতি চুমুকে ইউরেকা। 

- ধুত্তোরি। তখন থেকে ভ্যাজরভ্যাজর। 

- তুমিই তো চান্স দিচ্ছ ব্রাদার। বন্দুক বাগিয়ে ঢুকেছ৷ সোজা ঠাই ঠাই চালিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তা না করে যেই না ওই বাতেলা ঝাড়া শুরু করেছ তখনই বুঝেছি...স্কিলে খামতি আছে। তা এতক্ষণ যখন গালগল্প হলই, আর মিনিট দশেক দেবে নাকি? ব্রাদার?

- কোনও চালাকি নয় কিন্তু...খুব সাবধান।

- চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য ইয়ে হয়না। শোনোনি নাকি?

- দু'মিনিট দেব। তার বেশি নয়।

- পাঁচে রফা কর ভায়া। উইন উইন।

- আমি ঘড়ি দেখছি,  পাঁচ মিনিট পরেই কিন্তু..।

- ঢিশুম। জাস্ট ফাইভ মিনিটস।

- কী হবে পাঁচ মিনিটে?

- পেঁয়াজ কুচোতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। মামলেটের বদলে বরং পোচ করে আনি। আর ফ্লাস্কের কফি। 

- খাওয়ার শখ?

- আরে আমার জন্য না। ওই যে বললাম। মায়া নেই বলে তুমি শুকনো মুখে কেটে পড়বে। সে'টি হচ্ছে না। মায়ার খারাপ লাগবে। সে মরে গেছে বটে, কিন্তু উবে তো যায়নি। 

- দত্তবাবু। আমায় আর নার্ভাস করবেন না প্লীজ। আপনাকে খুন করাটা অত্যন্ত জরুরী।

- হাজরা পাঠিয়েছে? 

- আজ্ঞে। সোয়া লাখ পাবো। টাকাটার বড্ড দরকার।

- এ জন্যেই হাজরার মত বিজনেস রাইভাল আমার দু'চোখের বিষ। আর খুন করাবি করা, আমাদের ব্যবসার লাইনে এ'সব একটু না করলে চলবে কী করে৷ কিন্তু তাই বলে আমায় খুন করার রেমুনারেশন সোয়া লাখ? তুমিই বলো ব্রাদার, আমি কি অতই মামুলি?

- আজ্ঞে?

- হাজরা কী ভেবেছে। শুধু বিজনেস টার্নওভারে মেপে নিমাই দত্তের তল পাবে? হাজরা জানে যে নারায়ণ দেবনাথের কমিস্কের ব্যাপারে আমার চেয়ে বড় এক্সপার্ট গোটা দেশে নেই? জানে ও? ও জানে যে যে সতেরোটা ডায়েরী বোঝাই হয়ে আছে আমার লেখা গান? সে গানে সুরও নিজে বসাই আমি? ও জানে? রোজ রাত্রে হারমোনিয়াম নিয়ে ছাতে উঠে আমি নিমাইসঙ্গীত গাই! ব্যবসার খাতিরে খুন করছিস কর, তাই বলে সোয়া লাখের বিনিময়ে আমায় নিকেশ করবে? আটকালচারড ব্রুট কোথাকার। 

- আজ্ঞে দত্তবাবু, আমি ছাপোষা খুনি। ও'সবের আমি কী বুঝি বলুন। 

- ও মা। নারায়ণ দেবনাথ না বুঝলে চলবে কেন?

- খুনটা আমায় করতেই হবে।

- তাই বলে দেড় লাখে? না না। সে অন্যায় বরদাস্ত করা যায় না ব্রাদার।

- পাঁচ মিনিট কিন্তু শেষ হতে চলল।

- যাহ্। একটু ম্যানেজ করো ভাই। ডিমটা ভেজে না দিলে মায়া কষ্ট পাবে। 

- আচ্ছা। ইয়ে, দত্তবাবু। আমি পেঁয়াজ কুচিয়ে দেব? মামলেটই হোক বরং। পোচের বদলে। নিজের জন্যেও না হয় একটা ভেজে নেবেন।

- এই অসময়ে? আমিও খাব একটা? কড়া ভাজা অমলেট? জিভটা যে সুড়সুড় করছে না তা নয়...কিন্তু অম্বলটম্বল হলে..।

- কিছু মনে করবেন না। খুনটা কিন্তু আমায় করতেই হবে দত্তবাবু।

- তাই তো। তা'হলে আর অম্বলের ভয় কীসের বলো ব্রাদার। আচ্ছা, হাঁসের ডিমের অমলেট চলবে? ফ্রিজে এখনও বেশ কয়েকটা আছে।

- তাই হোক। তা..রান্নাঘরটা কোন দিকে? 

- কিচেন এ'দিকে। কিন্তু তুমি গেস্ট হয়ে পেঁয়াজ কুচোবে?

- আমি সুপার ফাইন পেঁয়াজ কুচোতে পারি দত্তবাবু। আমার বৌ হাতে ধরে শিখিয়েছিল। মামলেটের জন্য একেবারে নিখুঁত।

- বটে? 

- আজ্ঞে। ইয়ে..তার নামও ছিল..মায়া।

- ছিল? ব্রাদার?

- সেও এখন ফটো। আমাদের শোওয়ার ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়ালে, তারামা হার্ডওয়্যার স্টোরের ক্যালেন্ডারটার পাশে ঝোলানল। রোজ ঘুমোনোর আগে খোকা সেই ফটোফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আমার কাছে গল্প শুনবে। শুনবেই। ওর মায়ের গল্প। মায়ার গল্প। 

- অ।

- আসলে..টাকাটা আমার বড় দরকার দত্তবাবু। খোকার একটা অপারেশন না করালেই নয়। 

- অ। খোকার জন্য। এ সোয়া লাখ তো সোয়া লাখ নয় ভায়া। সোয়া'শো কোটির সমান। শোনো, এখন ডিম ভাজি। তারপর আর দেরী নয়। 

- আমায় ক্ষমা করতে পারবেন দত্তবাবু?

- মায়ার কাছেই যাওয়া তো। আমার বরং একটা হিল্লে হয়ে গেল। একা একা রোজ নিমাইসঙ্গীত গাইতে বসে বুক ফেটে যায় ভায়া, সবটুকুই তো মায়ারই জন্য। কিন্তু তোমার খোকার গল্পগুলো শোনাটা জরুরী৷ আমি তোমায় বাড়তি টাকা দিতেই পারতাম, আমি তো আর ওই হাজরার মত চশমখোর নই৷ কিন্তু এ কাজে ফাঁকি দিলে হাজরা তোমার ছড়বে না হে।

- দত্তবাবু..। হাজরার দলের বাকি লোকেরা বাইরে দাঁড়িয়ে। কাজ হলে লাশ আর প্রমাণ লোপাট করবে বলে। বিশ্বাস করুন আমি যদি খুন নাও করি ওরা আপনাকে..।

- কেঁদো না ভায়া। মাঝেমধ্যেই মায়াকে বলি, আসছি গো। তোমার কাছে আসছি। শুধু সাহসের অভাবে এদ্দিন..। যাক, এই ভালো। তোমার খোকার জন্য আমার হারমোনিয়ামটা দিয়ে গেলাম। বসার ঘরেই রাখা আছে। নিয়ে যেও। আর শোনো, খোকাকে ওর মায়ের গল্পে রেখো, কেমন? দেখো একদিন সে মস্ত বড় মানুষ হবে।

- দত্তবাবু...।

- আর দেরী নয়। পেঁয়াজ কুচোও ব্রাদার। ওমলেটের ব্যাপারটা কুইকলি সেরে ফেলা যাক। নয়ত তোমার স্যাঙাৎরা এসে রসভঙ্গ করবে।

বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন

$
0
0
- কাকে চাই?

- ম্যাডাম, এ'টা কি অমলেশ সমাদ্দারের বাড়ি?

- ওই ঢাউস নেমপ্লেটটা চোখে পড়েনি? ও'টায় কি অমলেশ সমাদ্দার লেখা আছে?

- এইচ দত্ত। ওহ, সরি। সরি। আসলে..।

- বাড়ির নম্বর কিছু আছে?

- বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন।

- গুলিয়েছেন।

- গুলিয়েছি?

- এক্কেবারে।

- আসলে গুগল ম্যাপ ধরে..।

- ম্যাপকানা হয়ে অলিগলিতে ঢুকলে ওই হয়। ঝাড়া আড়াইশো মিটার পিছিয়ে গিয়ে শনিমন্দির পড়বে। সে'টার বাঁদিকের গলিতে ঢুকে ডান হাতের চার নম্বর বাড়ি।

- থ্যাঙ্কিউ।

- ও মা! কড়াইয়ের মাছ পোড়া লাগল বোধ হয়...।

**

ঘাটে এসে গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করল নির্মলের। শেষ বিকেলের রোদ্দুর নরম হয়ে এসেছে। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে পছন্দসই একটা জায়গা দেখে জলে গোড়ালি ডুবিয়ে বসল সে। প্যান্টে শ্যাওলার দাগ বসে যাবে, যাক গে। আজ গায়ে বুকে বড় নিবিড় ভালোলাগা লেগে আছে। 

পকেট থেকে বাদামের প্যাকেটটা বের করে ডান হাতের মুঠোয় কয়েকটা নুনমাখানো বাদাম ঢেলে নিয়ে সামান্য গুনগুন শুরু করল নির্মল। 

বুকের ভিতরটা কেমন তিরতির করছিল, ওই ভালোলাগায়। সুমির সংসার; সে এক জমকালো ব্যাপার।
সুমির রান্নাঘরের কড়াইতে মাছ।
সুমির কোমরে গোঁজা শাড়ির আঁচল।
সুমির থুতনিতে ঘামের দানা।

দেখে প্রাণ ভরবে না কেন?  আর কেউ না জানুক, নির্মল তো জানে; তাঁর বুকে হিংসের একটা ফোঁটাও নেই৷ মাকালীর দিব্যি কেটে সে বলতে পারে। 

কী বিচ্ছিরি পাগলামি যে আজ হঠাৎ মাথায় চেপে বসল! যাক, সে পাগলামীর বশে এদ্দিন পর দেখা তো হল। ক্ষণিকের কথাবার্তা, এ দাড়িগোঁফে ঢাকা বাউণ্ডুলে চেহারা সুমি চিনতে পারবেনা; এ'টুকু ভরসা ছিল। নাহ্, সুমিকে কোনওভাবেই বিরক্ত করা চলবে না।

সুমি যে কী ভালো। কী ভালো। এই যে গায়ে মুখে লাগা শেষ বিকেলের আলো আর পা ভেজানো নদীর জলের মিঠে শিরশির; আর দু'টো মিলেমিশে এই যে মনঅবশ করা ভালোলাগা - সুমি তার চেয়েও ভালো। 

চারদিকে কতশত মনকেমন করা ভালো; সঞ্জীবের বইতে রাখা ভোরের শিউলি ভালো, জলপটিতে মায়ের হাতের ওমটুকু ভালো, খিদেপেটে গরম ভাতের গন্ধ ভালো ।  আর সে'সমস্ত ভালো মিশলে যে কান্না; সুমি সে'খানে।

বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন; নির্মলের অল্প হাসি পায়। 

**

বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন; যত্তসব!

সাজানো ঠিকানার অছিলায় দেখা করতে আসায় দোষ নেই, আর কড়াইতে মাছের মিথ্যেটুকুতেই যত পাপ? মোটেই না। সুমি জানে, পাপ নেই তাতে। 

এদ্দিন পর যে লুকিয়ে দেখা করতে আসে, তার সামনে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলা যায় নাকি? সুমি জানে, যায় না।

নির্মলের সাহস না থাক, এক ফোঁটা হিংসুটেপনাও কি থাকতে নেই? 

**

(পুনশ্চঃ হটস্টারে "আরিয়া"ওয়েবসিরিজটি দেখলাম। এ লেখার সঙ্গে অবশ্য সে সিরিজের কোনও যোগাযোগ নেই। তবে 'বড়ে অচ্ছে লগতে হ্যায়'গানটা মনের মধ্যে নতুন করে দাগ কেটে গেল। এই আর কী)

তিব্বতি মাদুলি

$
0
0

- মনখারাপ?

- আজ্ঞে। প্রচণ্ড। টেরিফিক লেভেলে মনখারাপ।

- সে তো বুঝলাম। কিন্তু কেন? জয়েন্টে ফেল? মিনিবাসের পকেটমারিতে সত্তর টাকা জলে? 

- কই। না তো।

- তোমার বয়সে তো এ'সবই হয় খোকা...।

- খোকা? অমল বলে ডাকলেই হয় তো। ফার্স্ট ইয়ারে রয়েছি স্যার।

- স্যার? সাতাশ বছর হল তিব্বত থেকে ফিরে তন্ত্রসাধনা করছি। তাবিজমাদুলি দিচ্ছি। স্যারট্যার আবার কী। এ কি ডালহৌসির প্রাইভেট ফার্ম নাকি। গদগদ সুরে বাবাজী বলে ডাকো।  

- বাবাজী। আমার যে বড্ড মনখারাপ। সুপার-গভীর মনখারাপ। জিভে ফুচকাও তিতকুটে হয়ে ঠেকছে; এমন মনখারাপ। 

- কেস সিরিয়াস, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু মনখারাপের সোর্স না জানলে মাদুলিটা দেব কী করে?

- আমিও কী ছাই জানি? বড় আশা করে এসেছিলাম তিব্বতি মন্ত্রতন্ত্র ঝেড়ে আপনি যদি ট্র‍্যাক করতে পারেন। 

- নাহ্। অমন আনতাবড়ি মাদুলি আমি দিতে পারিনা৷ আমি ফচকে ব্যবসায়ী নই, সাধক। 

- ঝড়ে বক ছাড়ুন না কিছু একটা। এমন ওজনদার মনখারাপ দিনের পর দিন বয়ে বেড়ালে শোল্ডার ডিসলোকেট করে ফেলব তো। 

- ছাড়ব? ঝড়ে বক?

- নয়ত আর তন্ত্র কীসে?

- দাঁড়াও, কনসেন্ট্রেট করি।

- আমার মনখারাপের সোর্স...কন্সেন্ট্রেট করলে খুঁজে পাবেন? বাবাজী? 

- কনসেন্ট্রেট করে ডাকলে মাতারা জ্বরের রাতে কপালে জলপটি রেখে যান। ফোকাস ঠিক থাকলে স্বয়ং মহাদেব এসে বিড়িতে আগুন দিয়ে যান৷ তোমার মনখারাপের সোর্স তো অতি পাতি ব্যাপার হে।

- হোক বাবাজী হোক। কন্সেন্ট্রেট করে আমার মনখারাপের সোর্স খুঁজে বের করা হোক।

- তিব্বতের লামাদের মাংসের শিঙাড়া খাইয়ে এমন ইম্প্রেস করেছিলাম যে তাঁরা সাধনার প্রচুর শর্টকাট শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এই যেমন এখুনি; এখন এক লহমায় পৌঁছে গেলাম তোর মনখারাপের গোড়ায়। 

- তা, কী বুঝছেন?

- কাল সকালেই সে গায়েব। ফুসমন্তর এক্কেবারে।

- ফুসমন্তর? 

- ফুসমন্তর। মিছে কথা কইতে নেই খোকা। মনখারাপের কারণ তো বেশ স্পষ্ট জানা আছে দেখছি।

- মোটেও না। কে গায়েব হল, কে ফুসমন্তর তাতে আমার কী?

- কিচ্ছুটি নয়?

- নয়ই তো। আপনি বড় বাড়তি কথা বলেন বাবাজী।

- কাল সোয়া দশটার ট্রেন।

- ট্রেন হোক। প্লেন হোক। স্পেসশিপ হোক। আমার কিছুই এসে যায়না। মাদুলির ব্যবস্থা করুন, আমার তাড়া আছে?

- তাড়া আছে?

- এ...এ কী..আমার হাত খামচে ধরছেন কেন বাবাজী?

- পালস না মেপে মাদুলি দেব?

- আপনি তান্ত্রিক না হোমিওপ্যাথি জ্যেঠু?

- ফার্স্ট ইয়ারে চোখ ছলছল কাজের কথা নয় অমলবাবু।

- ও কিছু না। থাক মাদুলি।

- সোয়া দশটার ট্রেন। ফুসমন্তর।

- হাত ছাড়।

- আপনি আজ্ঞে থেকে তুই?

- বাবাজীটি টেরিফিক লেভেলের ভণ্ড।

- ডায়াগনোসিসটা টেরিফিক লেভেলের খাঁটি।

- মনখারাপটাও। যাসনা। 

- বাবার ট্রান্সফার। 

- তোর বাবাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ। 

- খুব মনখারাপ?

- ওই যে। টেরিফিক লেভেলে।

- মাদুলিটাদুলিতে কাজ হবে? তিব্বতি টোটকা?

- দিবি?

- ওই যে। লামাদের মাংসের শিঙাড়া খাইয়ে আদায় করা মন্ত্রের গুণে তৈরি মাদুলি। তোর কাছে রেখে যাব। যদ্দিন না ফিরি, মনখারাপের ইন্স্যুরেন্স। 

- বটে? টেরিফিক লেভেলের মাদুলি তো! সালোয়ারকামিজ পরা বিনুনি দোলানো বাবাজীর এলেম আছে। 

- এলেম? তা আছে। আর আছে কাল সোয়া দশটার ট্রেনের টিকিট। 


***

- অমলবাবু?

- ইয়েস?

- হ্যাপি বার্থডে।

- হেহ্। থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।

- কত হল বাইশ না তেইশ?

- তিরানব্বুইটাকে সত্যিই তেইশ বলে বোধ হচ্ছে ডাক্তার।

- প্রেশারটাও বেশ কন্ট্রোলে আনা গেছে। আর এই রিপোর্টগুলোও; পার্ফেক্ট। আপনার সেঞ্চুরি আটকায় কার সাধ্যি। 

- হোপ সো ডক্টর।

- আপনার মনটকে শুধু এমনই চনমনে রাখুন। তা'হলে সেঞ্চুরির পরেও চালিয়ে খেলতে পারবেন।

- মনখারাপ যে আমায় ছুঁতে পারেনা ডাক্তার।  

- বটে?

- সবই একটা তিব্বতি মাদুলির গুণ। 

- তিব্বতি মাদুলি? আমি তো জানতাম আপনি এথেইস্ট।

- কচু। আমার চেয়ে বড় থেইস্ট এ দুনিয়ায় নেই হে ডাক্তার। বাবাজী ফিরে আসবে, সে আশায় তিব্বতি মাদুলি বুকে আঁকড়ে কী প্রবল আনন্দে বেঁচে আছি। সেঞ্চুরিটা যে আমায় পেরোতেই হবে। আমি কেটে পড়ার পর বাবাজীর ওয়াপসি হলে একটা যাতা কাণ্ড ববে।

- তিব্বতি মাদুলিটা কিন্তু আমায় খুবই ইন্ট্রিগ করছে।

- সে হল গিয়ে তন্ত্রের মিরাকেল ডাক্তার। 

- সেই তিব্বতি মাদুলি? মিরাকেল?

- ইয়েস। অবিশ্যি, সেই তিব্বতি মাদুলিকে অবশ্য তোমরা বেরসিকরা চুমু বলে জানো। 

বটুগোয়েন্দার ইলিশচুরি

$
0
0

- এই যে বউ...।

- অত চেল্লাচিল্লি কেন।

- চেল্লাচিল্লি করার মতই দাঁও মেরেছি।

- চোরের গলায় অত তেজ ভালো না..।

- বিশু দারোগা চোর বলে চোপা করলে গায়ে লাগেনা। কিন্তু তুমিও চোরছ্যাঁচড় বলেই হ্যাটা করবে গো বউ? শিল্পীর কদর করবে না?

- উঁ। ভীড় বাসট্রেন থেকে এর ব্যাগ ওর থলে সরানোও নাকি শিল্প। ধুর ধুর শিল্পী ছিলেন মধুজ্যেঠু। গেরস্ত বালিশে মাথা ঠেকানোর দশ মিনিটের মধ্য সিঁদ কেটে মালপত্তর সরিয়ে হাওয়া।

- আরে সে মান্ধাতা আমলে পড়ে থাকলে চলবে কেন। ইন্টারনেটে চারদিকে কিস্তিমাত হচ্ছে। এ যুগে সিঁদ কাটলে লোক হাসবে যে। তবে যাক। আজ এক্কেবারে কেল্লাফতে করেছি। এই দ্যাখো।

- রামোহ্। চামড়ার দামী ব্যাগ নয়, জমকালো বটুয়া নয়, এ যে দেখি বাজারের থলে...। তাও ময়লা...।

- কিন্তু বউ, এ থলের মধ্যেই যে সাতরাজার ধন। 

- আহ, কী আছে সে'টা বলবে তো।

- ডাউন মেমারি লোকালে ফিরছিলাম। তখনই নজরে পড়ল লোকটাকে। গোবেচারা চেহারা, ট্রেনের দরজার এক্কেরে মুখে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছেন বাবু। ...দেখেই বুঝেছি এর মাথায় কাঁঠাল ভাঙা বাংলায় বানানভুল করার চেয়েও সহজ। ব্যাস। অমনি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তা ভদ্দরলোকের হাতে ঝোলানো থলির ভিতর উঁকি মারতেই বুকের মধ্যে এক্কেবারে যেন সাতশো বত্রিশটা রংমশাল জ্বলে উঠল। ঠিক করে ফেললাম এ ব্যাগ না হাতালেই নয়..। ভদ্রলোক শক্ত করে থলেটা ধরেছিলেন..। প্রথমে ভাবলাম।যে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন গতি নিলে; সে ব্যাগ শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে পগারপার হওয়াটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু মা ভবতারিণীর আজ অসীম দয়া; ছিনতাইয়ের হ্যাপা পর্যন্ত যেতেই হল না। হঠাৎ এক প্যাকেট সল্টেড বাদাম কিনে খেতে শুরু করলেন ভদ্রলোক,হাতের থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে। সে বাদামের নেশায় এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলেন যে আমি দিব্যি থলে উঠিয়ে পাণ্ডুয়া স্টেশনে স্যাট করে নেমে পড়লাম অথচ সে'টা সেই থলেওলা টেরই পেলেনা। 

- হাউই গপ্প তো অনেক হলো। তা এই থলেতে আছেটা কী?

- দেখাব। তার আগে খোকা আর খুকিকে ডাকো দেখি। ওদের সামনেই না হয়...।

***

- পৌনে দু'কিলো সাইজের ইলিশ?

- করেক্ট।

- দু'টো ইলিশ?

- করেক্ট।

- কোয়ালিটি?

- এ-ক্লাস।

- তুমি জানো সে জিনিসের মার্কেট ভ্যালু কত?

- হিসেব করতে গেলে ভির্মি খেতে হবে। থাক না।

- থাক না মানে? অমন ইলিশ সহ থলে গায়েব হয়ে গেল?

- গায়েব নয়। চুরি।

- বটু গোয়েন্দার ইলিশ মাছের থলি চুরি হল?

- এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে সুবিনয়।

- অবাক হব না বটু? থানার বড়বাবুরা তোমার কনসাল্টেশনের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে। দুঁদে ক্রিমিনালরা তোমার নাম শুনলে থরথর করে কাঁপে। তেমন গোয়েন্দার মাছের থলে চুরি হয়ে গেল ট্রেনের ভিড়ে, অথচ সে টেরটিও পেল না। বাজারে এ কথা রটলে তোমার মানইজ্জত থাকবে বটু?

- মানইজ্জতের পরোয়া করলে কি আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াতাম হে সুবিনয়। সে চিন্তা নেই।  ইলিশের থলে চুরি হয়েছে বটে, কিন্তু তা আমায় ফাঁকি দিয়ে হয়নি।

- তার মানে? তুমি টের পেয়েছ যে তোমার থলি চুরি হচ্ছে?

- হাপিসটি হয়েছে পাণ্ডুয়া স্টেশনে। আর চুরিটা হয়েছে আমার সুপারভিশনে।

- তার মানে?

- চুরিটা আমি অ্যালাউ করেছি।

- তুমি চুরিটা হতে দিয়েছ?

- করেক্ট।

- তুমি দেখেছ সে চোরকে?

- বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে সাতচল্লিশের মধ্যে। একমাথা এলোমেলো ময়লা চুল, নীল শার্টটিকে আর যাই হোক নতুন বলা চলে না। ট্রাউজারটা এককালে হয়ত মিশকালো ছিল, এখন ফ্যাকাসে। পায়ে সস্তা হাওয়াই চটি। হাতে একটা পুরনো ইলেকট্রনিকস ঘড়ি, নেহাৎ শস্তা নয় তবে সে'টি যে চুরির মাল সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। 

- তা এই লোকটিকে তুমি তোমার থলে সরাতে দিলে?

- দিলাম। ইনফ্যাক্ট, যতটা সম্ভব সাহায্য করলাম। 

- খোলসা করো হে বটু।

- চোরের হাবভাব আমি বিলক্ষণ চিনি। তাঁদের আঙুল আর কবজির মুভমেন্ট, চোখের ধারলো ফোকাস আর ঠোঁটের পরিশীলিত উত্তেজনা; এই কম্বিনেশনটা নিশ্চিত ভাবে ঠাহর করতে পারাটা যে কোনও গোয়েন্দার জন্যেই একটা জরুরী স্কিল। তবে এই ভদ্রলোক..।

- ভদ্রলোক?

- সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় নিজের আখের গোছানো মানুষজন যদি ভদ্র হতে পারেন, সামান্য পকেটমারকে ছোটোলোক বলি কী করে বলো। যাকগে, তা অন্যদের পকেট আর ব্যাগ জরীপ করতে করতে এই নীল শার্ট ভদ্রলোকটি হঠাৎ একটা বই হকারের কাছে ছোটদের বই চেয়ে দরদাম শুরু করলেন। ওই সস্তা চটিবই। ট্রেন কাঁপানো দরদাম করে দু'টো বই বাগালেন ভদ্রলোক; একটা গোপাল ভাঁড়ের হাস্যরস আর একটা বীরবলের গল্প। কেনার পর বইগুলো নিজে একবারও উল্টেপাল্টে না দেখে নিজের বুকপকেটে যত্ন করে মুড়ে রাখলেন। বই কেনার সময়টুকু ভদ্রলোকের চোখ থেকে সেই ফোকাস গায়েব, ঠোঁটের উত্তেজনা কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি আর আঙুলের চনমন গায়েব। কেন?

- কেন?

- শিল্পীর ফোকাস আর উত্তেজনা ভাসিয়ে দেওয়া স্নেহ। বাড়ির বাচ্চাদের জন্য কি ভদ্রলোক দু'টো বই হকারের ব্যাগ থেকে সরিয়ে দিতে পারতেন না? পারতেন৷ কিন্তু তা করলেন না কেন? কারণ ছোটদের পড়ার বইটুকু তিনি চুরি করে সংগ্রহ করতে চাননি। শিক্ষার প্রতি সম্মান। আমাদের অনেকের মধ্যে নেই, ওঁর আছে। আসলে মানুষের এথিকস বোধ অতি বিচিত্র হে সুবিনয়। যা হোক, বইদুটো কেনার পর ভদ্রলোকের চোখের ফোকাস আর ঠোঁটের উত্তেজনা ফেরত এলো। অর্থাৎ তিনি ফের শিকারী বাজপাখি। এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। তাঁর দৃষ্টি এসে পড়লো আমার থলের ওপর৷ প্রমাণ সাইজের দু'টো ইলিশ দেখে তার চোখের দৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে ওঠা উচিৎ ছিল, ঠোঁট লোভে কেঁপে ওঠা উচিৎ ছিল। অথচ...।

- অথচ?

- অথচ তার দৃষ্টি হয়ে উঠল ঘোলাটে। ঠোঁটে ফুটে উঠল বিষাদ। আর নিজের অজান্তেই তিনি বুক পকেটে মুড়ে রাখা বইদুটো খামচে ধরলেন। এথিকসের মতই, পিতৃস্নেহও রীতিমতো বেহিসেবী একটা প্রসেস৷ আমার ইলিশের থলিটি তাকে টানলো কিন্তু সে টানে লোভ নেই৷ সে টানে নিজের সন্তানদের মুখে ইচ্ছেমত মাছের টুকরোটা তুলে দিতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে৷ যন্ত্রণা রয়েছে। ব্যাস, তারপর আর কী। মক্কেলের ঘাড় মটকে আদায় করা ইলিশ আবারও জুটেই যাবে।

- ইলিশভাজা দিয়ে জমিয়ে আড়াই থালা ভাত খাবো ভেবে এসেছিলাম হে বটু। কাজটা তুমি খারাপ করোনি বটে৷ তবু আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি খালি বোধ হচ্ছে..।

- গোয়েন্দাগিরির নেশায় মশগুল না হলে আমি অতি চমৎকার রাঁধুনি হতাম সুবিনয়। যাকগে, হাঁসের ডিম কষা করেছি, তাতেও ওই আড়াই থালা ভাত সাবাড় হবেই। দেখে নিও।

টেলিপ্লে

$
0
0

এই নিয়ে দুশো বাইশ নম্বর চিঠি পেলেন রাধামাধব। একেবারে নিয়ম বেঁধে। আর্লি রাইজার রাধামাধবের ঘুম ভাঙবে ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায়; মোবাইলের অ্যালার্মে। আড়মোড়া ভাঙার আগেই বালিশের তলায় চালান করে দেওয়া আঙুলের ডগাটি ঠেকবে গিয়ে খামের আরামদায়ক খসখসে। 

সেই খামটা বালিশের তলা থেকে টেনে বের করে আনতেই একটা মনকেমন করা মিষ্টি সুবাসে ঘর ভরে যাবে। ঠিক যেন ওই শিউলি আর পায়েস মেশানো একটা গন্ধ। সে সুবাস নাকে এসে ঠেকলেই মনে চনমন, প্রাণে ফুরফুর।  

একে মাঝবয়সী মানুষের একার সংসার, তার ওপর বিশ্রী একটা ভাইরাসের ঠেলায় প্রায় বছর দুয়েক  বাড়ির বাইরে এক পাও বেরোনো হয়নি। ইন্টারনেটের ঘ্যাঁচরঘোচর, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের হিজিবিজি আর নিষ্প্রাণ হোম ডেলিভারির চোটে প্রাণ প্রায় শুকিয়ে যেতে বসেছিল।কিন্তু সেই শুকনো খটখটে প্রাণে দু'পশলা বৃষ্টির মত এলো এই চিঠি। 

ব্যাপারটা শুরু হয় মাস সাত-আটেক আগে। তা প্রায় ভোজবাজিই বলা চলে।   ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই একটা করে চিঠি। রোজ। সে চিঠির হাতের লেখাটি বড় সুন্দর; ছাপার অক্ষরের মত উজ্জ্বল কিন্তু কাঠকাঠ নয়, বেশ মিষ্টি। সাদা খামের ওপরে যত্নে লেখা নাম; রাধামাধব দত্ত। আর সেই মিঠে হাতের লেখায় নিজের নামটুকু বারবার পড়তে বড় ভালো লাগে রাধামাধবের।  সাদা খামের ভিতরে হলুদ রঙের মোটা কাগজ। তার ওপর নীল কালিতে লেখা একটা গানের প্রথম দুলাইন। 

এক একদিন, এক একটা গান। কোনওদিন হেমন্তবাবুর "জীবনপুরের পথিক"আবার কোনওদিন মান্নাবাবুর "চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে”। ব্যাস, ও'টুকুই। কার হাত ছুঁয়ে সে চিঠি রাধামাধবের বালিশের তলায় এসেছে, সে’টুকু এত দিনেও জানা গেল না। অবশ্য তা জানার চেষ্টাও করেননি রাধামাধব। ঘুম থেকে উঠে অমন সুগন্ধি চিঠি হাতে পেলে মন যে দিব্যি তরতাজা হয়ে পড়ে, কী হবে চিঠি লিখিয়ের খোঁজ করে? বালিশের তলায় সে চিঠি পৌঁছয় কী করে তা নিয়েও মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না রাধামাধবের। বড় কথা হল সে চিঠি আসে। রোজ আসে, নিয়ম করে আসে। ম্যাজিকের মত, ছুঁতে না পারা কলেজ প্রেমের মত; ব্যাস। এর বেশি কিছু জানতে রাধামাধবের বয়েই গেছে। 

সে চিঠি খুলে গানের দুলাইন পড়লেই একটা সুরের মখমলে ঢেউ এসে রাধামাধবের বুকে দোলা দেয়। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের টেবিল থেকে বাঁশিটা টেনে নিয়ে সেই গানের সুর ধরেন রাধামাধব। মনের মধ্যে ভালোবাসা জমতে শুরু করে, শিউলি আর পায়েস মেশানো সুবাসে ভেসে যান তিনি। 

****

- এই দ্যাখ বিন্তি। 

- এটা কী রে দাদা। 

- টেলিপ্লে স্পীকার। 

- কী সব গালভরা নাম বলিস রে তুই দাদা। এ'দিকে এ যে দেখছি স্রেফ একটা থ্যাব্যড়া বাক্স। তাও যা মনে হচ্ছে, সস্তা কাঠের। 

- দেখতে থ্যাবড়া বেঢপ বটে। কিন্তু এ হচ্ছে লেটেস্ট টেকনোলজিকাল মিরাকেল। 

- কী'রকম? 

- ঐযে, মানুষদের যেমন গুগল হোম বা আমাজন ইকো বা ওই ধরণের যন্ত্রপাতি? যে গান শুনতে চাইবি অমনি স্পিকারে সে গান বেজে উঠবে? এও তাই, তবে মানুষদের জন্য নয়। তোর আর আমার মত ভূতেদের জন্য।

- যে গান শুনতে চাইব পাব? 

- আলবাৎ। শুধু এই ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে একটা চিঠি ফেলে দিলেই হবে। 

- চিঠি?

- সাদা খামের মধ্যে হলুদ কাগজে সে গানের দু'লাইন লিখে দিলেই হবে। 

- সত্যি রে দাদা?

- তুই আমার একমাত্র আদরে বাঁদর বোন, তোকে মিথ্যে বলব রে? ঘোস্টকার্টে মদন তান্ত্রিকের লেটেস্ট রিলিজ। ফ্ল্যাশসেলে কলেক্ট করেছি বিন্তি। শুধু তোর জন্যে। আর প্রচণ্ড কাসস্টোমাইজেবল। ওকে গুগল বা আলেক্সা গোছের একঘেয়ে কম্যান্ডে শুধু সাড়া দেবে, এমন ত্যাঁদড় নয় এই টেলিপ্লে। তুই নিজের পছন্দমত নাম দিতে পারবি এই যন্ত্রের। 

- ফাটাফাটি। আমি কিন্তু সবসময় শুধু বাঁশি শুনব। বলে রাখলাম। 

- বেশ তো, শুনিস'খন । আর এর নামটা কী দিবি?

- রাধামাধব। কেমন?

হেবো গুণ্ডার হবু স্যাঙাৎ

$
0
0

- নাম?

- আজ্ঞে, অনিন্দ্য।

- ঝাঁজ নেই।

- আজ্ঞে?

- নামে ঝাঁজ নেই। অমন নেতানো নাম নিয়ে বড় জোর বেনামি জমির দালালি করা যেতে পারে,গুণ্ডামি নয়। হেবোগুণ্ডার স্যাঙাৎ হতে হলে নামে ধার চাই হে।

- অমন বলবেন না হেবোদাদা। অমন বলবেন না। বড় আশা করে এসেছি আপনার কাছে। গুগল দেখে বোমা বানানো শিখেছি, একলব্য হয়ে ঘরে বসে নিজের খাটের তোষকে ছুরি ঢোকানো প্র‍্যাক্টিস করেছি৷ সবই শুধু আপনার কথা ভেবে। বড় সাধ, একদিন আপনার চরণে নিজেকে সঁপে দেব। বড় সাধ। 

- সে কত লোকের কত রকমের সাধ হয়। কেউ চায় ওবামার সঙ্গে বসে লুডো খেলতে, কেউ চায় মুকেশ আম্বানির ক্যাশিয়ার হতে। চাইতে তো ক্ষতি নেই চাঁদ৷ কিন্তু রামকৃষ্ণ না অনুপম কে একটা বলে গেছে; সব পেলে নষ্ট জীবন।

- একবার যখন আপনার দেখা পেয়েছি হেবোদাদা , ওই শ্রীচরণের আশ্রয় ছেড়ে আমি আর নড়ছি না।

- আইআইটির ক্যাম্পাসে ঘুরতে গেলেই কি আইআইটির একজন হওয়া যায় রে পাগলা? সবুজ ঘাসে গড়াগড়ি খেলেই কি জন্টি রোডস হওয়া যায়? যায় না। আমার আশ্রয়ও ঠিক তেমনই৷ কত খতরনাক খুনী মাস্তান আমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করছে। এই তো সে'দিন এক সিরিয়াল কিলার এসে হত্যে দিয়ে পড়ল। কিন্তু..।

- কিন্তু?

- ঘুরঘুর করলেই হল নাকি? আমার স্যাঙাৎ হতে চাইলে থাকতে হবে হাইভোল্টেজ কিলার ইন্সটিঙ্কট৷ মামুলি দশ বিশটা খুন করলেই হল না, ঘ্যাম থাকতে হবে৷ 

- ও নিয়ে ভাববেন না। এ তুলোতুলো নাম পাল্টে ফেলে জংধরা পেরেক মার্কা কিছু একটা রাখব'খন। ফাটাবাঁশ বা আসমানিবেল্লিক গোছের কিছু চলবে?

- বেশ। নামের ব্যাপারটা না হয় কিছু একটা ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু শোন, স্যাঙাৎ গভীরভাবে নৃশংস না হলে আমার   চলবে না যে।

- আমি প্রচণ্ড নৃশংস তো। প্রচণ্ড।

- প্রচণ্ড?

- মাইরি হেবোদাদা। মাইরি।

- নৃশংসতায় আমার মন গলানো সহজ নয়৷ ওই যে বললাম, খুনোখুনি ভাংচুর করলেই হবে না৷ 

- আমি যে কী চিজ..।

- শুনি...।

- আমি বিরিয়ানিতে কড়াইশুঁটি আর শসাকুচি ফেলে খাই।

- ইইইইকী...।

- আমি গল্পের বইয়ের পাতায় মাসকাবারির ফর্দ লিখি। তাও স্কেচপেন দিয়ে। 

- না না..না..না। না!

- আমি কেসি দাসের রসগোল্লা চেবানো তৃপ্ত মানুষের কানে ফিসফিস করে কেসিনাগের খটরমটর অঙ্ক আবৃত্তি করে শোনাতে পারি। 

- কেমন একটু অস্বস্তি হচ্ছে এ'বার।

- আমি প্রিয় ব্যটসম্যানের উইকেটের তোয়াক্কা না করে পয়া বসবার জায়গা পাল্টে ফেলতে পারি।

- থাম, থাম, থাম।

-  বাইশটা লম্বা ওগো-হ্যাঁগো চিঠির উত্তরে একটা কাঠকাঠ পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দায়িত্ব সেরে নিতে পারি।

-  এদ্দিন কোথায় ছিলি বাবু। বুকে আয় ভাই, বুকে আয়।

প্যান্ডেমিক

$
0
0

- ধুর শালা প্যান্ডেমিক! উফ!

- যা বলেছ ভায়া। প্রাণ ওষ্ঠাগত এক্কেবারে।

- কী খতরনাক ভাইরাসের পাল্লায় যে পড়লাম..।

- এক্কেবারে হুলুস্থুল অবস্থা। তাই না?

- গোড়ার দিকে কিছুতেই ঠাহর করতে পারিনি যে জল এদ্দূর গড়াবে।

- গভর্নমেন্টই ঘোল খেয়ে গেল হে। আমরা তো টোটাল আতিপাতি আর আলটিমেট এলেবেলে। 

- গভর্নমেন্টকে দোষই বা দিই কী করে বলো। এমন ক্যালামিটি এই সেঞ্চুরিতে আগে কেউ কি দেখেছে? বিলেত আমেরিকা টলে গেল, আমরা কোথাকার কোন হরিদাস পাল। তা ভায়া, ভ্যাক্সিনের খবর কিছু শুনেছ? আশার আলো আছে কিছু?

- কানাঘুষো যা শুনছি..তা খুব একটা কনফিডেন্স ইন্সপায়্যারিং নয়৷ অন্তত বছর দুয়েকের আগে তো তেমন কোনও আশা দেখছি না...।

- দু'বছর? দু'বছর ফেসমাস্ক না পরে থাকতে হবে?

- যে দেবতা যাতে তুষ্ট। মাস্ক পরলেই এই ভাইরাস এসে ক্যাঁক করে ধরবে। এমন খতরনাক ব্যাপার যে হতে পারে তা কেউ কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল?

- সত্যিই, একটানা মাস্ক না পরে থাকা, সে যে কী অস্বস্তিকর।  মনে হয় যেন উলঙ্গ হয়ে ঘোরাঘুরি করছি৷ রাত্রে তো ঘুমই আসতে চায়না। মাঝেমধ্যে পাশবালিশ দিয়ে মুখ নাক ঢাকি বটে কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোল চেটে মেটানো যায় বলো।

- গিন্নীকে দু'টো কাঞ্জিভরমের মাস্ক দিয়েছিলাম, জলে গেল। তবে শুধু তো সে'টুকুই নয়৷ মাস্ক ইন্ডাস্ট্রি যে পথে বসেছে। ইকোনমি গেঁজে যেতে বসেছে৷ চারদিকে হাহাকার। এ যে কী দুর্যোগ! 

- সত্যিই৷ রোজ সকালে উঠে মনে হয় যেন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি। এই দেখ, চারপাশের সবকিছু রিয়েল কিনা ভেরিফাই করতে গিয়ে নিজের গায়ে এমন রাম-চিমিটি কেটেছি যে কালশিটে পড়ে গেছে।

- আহা রে। 

- আর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে এই রোজ রোজ বাজার যাওয়া। ব্যাটাচ্ছেলে প্যান্ডেমিকের পাল্লায় পড়লাম  সমস্ত হোমডেলিভারি বন্ধ। বাপের জন্মে ভাবিনি যে এমন এক থার্ডক্লাস ভাইরাসের পাল্লায় পড়তে হবে যাকে আটকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষের গিজগিজে ভীড়ে গিয়ে মেশা। উফ! ডিসগাস্টিং টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি।

- সত্যিই ভাবা যায়না। কী ডেঞ্জারাস ব্যাপার। রাস্তায় বেরোলেই বুক কাঁপছে।  প্রতিবেশী টু হাফ-চেনা পুলিশদাদাটি; যে কেউ গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে  কোলাকুলি করার জন্য। আহ্, ভাবলেই গা শিউরে উঠছে,গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। 

- সত্যিই। এ যন্ত্রণা আর নেওয়া যাচ্ছে না ভাই। তিন মাস ধরে মেগা সাইজের সব প্যান্ডেল দাঁড় করিয়ে পুজো হচ্ছে স্রেফ ভীড় জেনারেট করতে। বিজয়া আদৌ আসবে কিনা, আসলে কবে আসবে; কেউই জানে না।আর আজকাল তো লকডাউন ব্যাপারটাকেই অবাস্তব এক ইতিহাসের মত মনে হয়।

- এই একটানা পুজো হল আর একটা মেনেস! কী গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। মোবাইলে পুজো অ্যাপের বোতাম ফিঙ্গারপ্রিন্টে অ্যাক্টিভেট না করে বারোয়ারী প্যান্ডেলে,  হাতে ফুল চটকে, ভীড়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কম্পালসরি অঞ্জলি দেওয়ার এই যে ন্যাকাপনা; তা কহাতক বরদাস্ত করা যায়? আর তার ওপর গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েছে এই ওয়ার্ক ফ্রম অফিস। 

- তা আর বলো কেন। ভাবতে পারো...ওয়ার্ক ফ্রম অফিসের জ্বালায় উইকডেতেও রাস্তাঘাটে রীতিমতো ট্র‍্যাফিক জ্যাম হচ্ছে? দিনে দিনে আর কত দেখব? 

- নাহ্। মনখারাপ ক্রমশ গভীর হচ্ছে ভায়া। শুধু আমার একার নয়, চারদিকেই এক অবস্থা। দেখো কপালে আর কত কী আছে। কবে শুনব ডিজিটাল বুকক্রিকেট-টুকুও ব্যান করে দেওয়া হবে। শুনেছ তো, নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে দেশের প্রতিটি শহরে। 

- স্টে...স্টেডিয়াম? এ কোন মান্ধাতা আমালে আমরা ফিরে যাচ্ছি? শেষে কি আমরা ডার্ক-এজের মত কাঠের ব্যাট আর চামড়ার বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করব?

- করব। এবং জোর করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে মানুষকে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হবে সে'খেলা দেখার জন্য। আর সে'খানেই শেষ নয়। তোমার পেয়ারের নেটফ্লিক্সও জলে গেল বলে। নেটফ্লিক্সের জন্য মানুষ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না, তাই রাস্তায় ভীড় তৈরি হচ্ছে না আর তার ফলে বেড়ে চলেছে ভাইরাসের অত্যাচার।

- নাহ্। এ অসহ্য৷ আর কয়েকমাসের মধ্যে বাজারে ভ্যাক্সিন না এলে...।

- না এলে?

- রিভোল্ট করব! সরকারি নির্দেশ অমান্য করব। অন্তত একটা টোকেন প্রটেস্ট করবই।

- প্রতীকী প্রতিবাদ? কী'রকম?

- হপ্তায় তিনদিন বাধ্যতামূলক ফুচকা খাওয়া? ভীড়ে দাঁড়িয়ে? লাইন দিয়ে? মানছি না! মানব না! আর দু'মাস অন্তর পুরী বা দার্জিলিং গিয়ে লাফালাফি? নেভার।  কভি নহি!

প্যান্ডেমিকের পুজোর প্ল্যান

$
0
0

- কী ব্যাপার ছোটকা? ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মেডিটেট করছ নাকি?

- জুলাই মাস শেষ হতে চলল রে নিতাই।

- তা'তে কী?

- বছর এই সময়টা..।

- এই সময়টায় কী?

- এই সময় আমার বসকে তেল দেওয়ার কথা। বস নাচতে বললে ধেইধেই করব, বাজে চুটকি বললে হেসে গড়াগড়ি খাব, বসের ক্যাটক্যাটে রঙের বিশ্রী শার্ট দেখে বলব 'লুকিং অসাম'।

- বসকে তেল? ও মা, তুমি নাকি কেরিয়ারের জুজুকে পাত্তাটাত্তা দাও না৷ তা'হলে আবার আপিসিও তৈলমর্দন কেন?

- কেরিয়ার? প্রমোশনটমোশনের তোয়াক্কা? তা আমি সত্যিই করিনা। একার সংসার। ইএমআইয়ের ফাঁদে পা দিই না।  বসের তোয়াক্কা আমি করবই বা কেন? তবে...।

- তবে?

-  তবে পুজোর ছুটি আদায় করার জন্য আমি  মা কালীর পায়ে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ঠেকিয়ে নিতেও হেসিটেট করব না। বসকে তেল তো কুছ ভি নহি।

- ও। তা, তুমি বুঝি জুলাই মাস থেকে বসকে তেল দেওয়া শুরু কর? পুজোর ছুটি আদায়ের জন্য?

- শুরু করি জুন থেকে। মালিশ করে করে তাঁর ঘেউঘেউ মেজাজ নরম করে মিউমিউতে আনতে মাসখানেক লাগে। আর তারপর শুরু হয় রিয়েল স্ট্রাগল। 

- লেট মি গেস। আইআরসিটিসির ওয়েটিং লিস্ট?

- পেরেকের মাথায় ঘা দিয়েছিস। এই সময়টায় শিলিগুড়িমুখো সমস্ত ট্রেন ওয়েটলিস্টে থাকার কথা। মেজদা রেলের বড় অফিসার, ওর কাছে দু'দিন রাবড়ি নিয়ে যেতে হবে। যদি একটু বলেকয়ে কনফার্ম করাতে পারে। ওর আবার বড় বেফালতু আইডিয়ালিজমের বাতিক। মেজদার রাবড়ি ফেল করলে লাটুগুণ্ডার কাছে রামের বোতল নিয়ে যাওয়া। 

- লাটু? বোমা বাঁধতে গিয়ে যার..?

- লাটুর নিজের ডানহাতটা নেই বটে। তবে ও পাড়ার এমএলএ'র রাইট হ্যান্ড। লাটু চাইলে হিল্লে একটা হয়েই যায়। জুলাইয়ের মধ্যে টিকিটের ব্যাপারটা ফাইনাল হলেই মন ফুর্তিতে ডগমগ। তখন জমে অন্য খেল, দ্য গ্রেটেস্ট পুজো কনানড্রাম। 

- পাহাড় না জঙ্গল...তাই তো?

- ইউ আর আ ব্রাইট চ্যাপ নিতাই। এই জন্যেই যখনই আমি পাঁঠা কষাই; তোকে ডাকি৷ 

- পাহাড় আর জঙ্গলের হিসেবটা কী'ভাবে ম্যানেজ করো?

- নট ইজি। নিজের মনের মধ্যে ডুবসাঁতার দিতে হয়। নিজের মেজাজকে অ্যানালাইজ করতে হয়, বুকের ধুকপুককে ডিকোড করতে হয়। কখনও নিজেকে দাদার কীর্তির কেদারের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করি; ওই যে, 'স্বপ্নের নেচারটা ফোকাস'। তখন বুঝি যে এ'বারে পাহাড়ের ভাবগম্ভীর স্নেহ ছাড়া গতি নেই। আবার কোনও বছর নিজের মনের গভীরে পৌঁছে টের পাই যে আমি ওই সাহেব সিনেমার গোলকিপারের মত অস্থির হয়ে আছি; এ'বার জঙ্গলের মায়ায় নিজেকে বেঁধে না ফেললেই নয়। এই গোটা প্রসেসটা যেমন পোয়েটিক, তেমনই মিউজিকাল। 

- আর এ'বারে সেই কবিতা আর সঙ্গীত দু'টোই গেল জলে।

- রাস্কেল করোনা। নিনকমপুপ। হাড় জ্বালিয়ে ছাড়লে। কবিতা ডকে আর সঙ্গীত গোল্লায়৷ জুলাই শেষ হতে চলল অথচ পুজোয় ছুটি বাগানোর কোনও গা নেই। বসের গাম্বাট ঠাট্টাগুলো শুনলেই গা চিড়বিড়িয়ে উঠছে। ব্রাউজারে আইআরসিটিসি টাইপ করলেই কান্না পাচ্ছে৷ মেজদা রাবড়ির আব্দার করে ফোন করেছিল, ওর শুগার তুলে খোঁটা দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছি৷ লাটুকে দেখলেই ইচ্ছে করছে কান মলে দিতে। 

- খুবই চিন্তার ব্যাপার ছোটকা।

- ক্যাটাক্লিজমিক কেস। জুলাই শেষ হতে চলল। কোথায় এখন স্টলে গিয়ে পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলার খোঁজ করব! তা না! পুজোয় কী ব্র‍্যান্ডের অক্সিমিটার কিনব সেই ভেবে হদ্দ হচ্ছি। 

- মনখারাপ? খুব? ছোটকা?

- বুঝলি নিতাই, পড়াশোনায় চিরকাল মিডিওকার ছিলাম। প্রেম ব্যাপারটাও ঠিকঠাক এক্সেকিউট করতে পারলাম না। এখন কলম পেষাই করে মাসমাইনে আদায় করি৷ এক্সট্রা কারিকুলার বলতে লবডঙ্কা।  জীবনে একটাই পয়েন্ট অফ এক্সেলেন্স ছিল; পুজোর ছুটির প্ল্যানিং। এই করোনার খপ্পরে পড়েও সে'টা গেল কেঁচে। গুরুদক্ষিণা সিনেমায় সুগায়ক ভালোমানুষটি যখন গাইতে চেয়েও গাইতে পারছেন না; সে না পারার যন্ত্রণাটা যে কী অপরিসীম তা আজ আমি ঠাহর করতে পারছি৷

বিপ্লবের ঘুম

$
0
0

- ডাক্তার।

- হুম...।

- ডাক্তার!

- হুঁ।

- ডাক্তার চৌধুরী! ব্যাপারটা কী?

- ওহ। সরি বিপ্লববাবু। সরি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

- চুপ করে রয়েছেন অনেকক্ষণ।  তাই ভাবলাম...দেখুন...আপনি আমার কাউন্সেলর..আপনিও যদি চুপ থাকেন..।

- আসলে...কী বলব সে'টা ঠিক..। আপনার কথাগুলোই প্রসেস করার চেষ্টা করছিলাম..।

- ওহ। আই সী৷ 

- আপনার ধারণা...।

- ধারণা?  রিয়ালিটি৷ অবিশ্যি, অনেকগুলো রিয়ালিটির একটা। 

- লেট মী সামারাইজ। আপনার ধারণা প্রতিবার ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হয়।

- দ্যাট ইজ করেক্ট।

- অর্থাৎ আমি আজ রাত্রে ঘুমোতে গেলাম ডাক্তার রীতা সান্যাল হিসেবে। আমার ধারণা আমি আগামীকাল সকালবেলা আমার সাদার্ন এভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে; ঘুম থেকে উঠে, ব্রেকফাস্ট সেরে চেম্বারে এসে বসব, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস খেলতে যাব। কিন্তু আদতে কাল সকালে আমার ঘুম ভাঙবে সম্পূর্ণ অন্য একটা জগতে।  যে'খানে বয়স, শরীর, চেহারা সব এক থাকলেও আমার পরিচয়, মন ও চারপাশটা একদম আলাদা। আগামীকাল হয়ত আমাত ঘুম ভাঙবে বাঁকুড়ার সুতপা দত্ত হিসেবে,  হাইস্কুল টীচার। আর আমার আগের দিনের ডাক্তার রীতা সান্যালের স্মৃতি সমস্ত ধুয়েমুছে সাফ। বরং ঘুম ভাঙার পর আমার মাথার মধ্যে গোটা জীবন সুতপা দত্ত হয়ে থাকার স্মৃতি মজুত থাকবে। 

- একদম। তবে শুধু বাঁকুড়ার সুতপা দত্ত কেন, আফ্রিকার কোনও এক দেশেও আপনার ঘুম ভাঙতে পারে। এমন দেশও হতে পারে যে'টার অস্তিত্ব আপনার এই কলকাতার চেম্বারওলা জগতে নেই। সে'টাই প্রসেস।

- প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন প্রতিবার ঘুম থেকে ওঠার পর এই মেটামরফোসিসের মধ্যে দিয়ে যায় কিন্তু কেউই সে'টা টের পায় না।

- ইনফাইনাইট নাম্বার অফ প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস। ঘুম ভেঙে কখন কোন দুনিয়ায় কী রোলে অবতীর্ণ হতে হবে, কেউ ঠাহর করতে পারেনা। করতে পারার কথাও নয়। সবারই ঘুম ভাঙে একটা কন্টিনিউয়িটির বোধ নিয়ে। কিন্তু সবই ফাঁপা, প্ল্যান্টেড।

- প্ল্যান্টেড? ঈশ্বর? 

- সফটওয়্যার হলেও হতে পারে৷ আমি তো বিশারদ নই ডাক্তার। শুধুই একটা বাগ ইন দ্য সিস্টেম। ভুক্তভুগী।

- বাগ, কারণ আপনার ক্ষেত্রর ঘুমের পরেও আগের স্মৃতিগুলো মুছে যাচ্ছে না। 

- গতকাল আমার নাম ছিল আবিদকেহ, ধেজসিসব বলে একটা শহরে উটের মাংসের ব্যবসা করতাম। প্রায় র‍্যাগস টু রিচেস স্টোরি। বশেকুয়াক ভাষায় কথা বলতাম। এই শহর আর ভাষা কোথায় আছে জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না। তার আগের ঘুমের আগে আমার নাম ছিল হান্স। মগজে ছিল অন্য একটা জীবনের গল্প। মাস দেড়েক আগে একবার কলকাতার বাঙালি হয়ে একটা দিন কাটিয়েছিলাম বটে। নাম ছিল রজত মল্লিক।

- ঘুম ভাঙার পর আগের জীবনের স্মৃতি মুছে গিয়ে মাথায় নতুন একটা জীবনের স্মৃতি এমনভাবে প্ল্যান্ট হওয়ার কথা যাতে আড়মোড়া ভাঙা মানুষটির মনে হয় যে এই নতুন জীবনেই সে আজন্ম রয়েছে৷ রাইট? কিন্তু যেহেতু আপনি সিস্টেমের বাগ, সেহেতু আপনার মনের মধ্যে...।

- কয়েক হাজার জীবনের স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে আছে। জাতিস্মরদের কথা ভাবুন ডাক্তার৷ গতজন্মের কথা মনে পড়াটা কিন্তু আদৌ কোনও সুপারপাওয়ার নয়, সে'টা বরং একটা অপরিসীম যন্ত্রণা। থিওরেটিকাল লেভেলে সোনার কেল্লার মুকুলের কথাই ভাবুন না। এ জন্মে নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে কনেক্ট করতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল কেন? কারণ পূর্বজন্মের বাপ, মা, ছেলেবেলার স্মৃতি এসে এই জন্মের রিয়ালিটিকে গুলিয়ে দিয়েছিল৷

- রাইট। আপনার ব্যাপারটাও অনেকটা ওই জাতিস্মরের মতই..।

- তফাৎ একটা আছে। প্রতিবার ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটা গোটা জীবনের স্মৃতি আমার মনের মধ্যে জুড়ে যায়৷ সে এক নিদারুণ যন্ত্রণা ডাক্তার। কয়েক হাজার বাপ মায়ের স্নেহ, কত প্রেম, কত বন্ধুত্ব, কত জীবনসঙ্গী৷ কত অন্যায়ের স্মৃতি। কত অপরাধবোধ।  

- বিপ্লববাবু, আমি হয়ত বুঝতে পারছি আপনার যন্ত্রণাটা কতটা গভীর।

- সে জন্যেই তো আপনার কাছে আসা ডাক্তার৷ ঘুম পেলেই ভয়ে বুক কাঁপে। কোনও জীবন ভালো লাগলে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু একটা সময় তো চোখের পাতা লেগে আসবেই। তাই না?

- সে জন্যেই আমার কাছে আসা? ঘুমোতে যাওয়া নিয়ে ডিলেমা? 

- খুলেই বলি৷ এ জীবনের মেয়াদ কয়েক ঘণ্টার বেশি তো নয়, ভণিতার আর অবকাশ কই। আর ডাক্তারের বদলে না হয় রীতাই বলি। দেখো রীতা, বেশিরভাগ জীবনেই আমার পাশে তুমি থাকো। আর যে জীবনগুলোয় তুমি থাকোনা, তোমার খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। ঘুম ভাঙতেই দেখি পাশে তুমি আছ কিনা। মাঝেমধ্যে অন্য কাউকে দেখি,  তখন কুঁকড়ে যাই, সুযোগ খুঁজি ফের ঘুমিয়ে অন্য জীবনে পৌঁছে যাওয়ার। 

- এ'বার ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যাচ্ছে বিপ্লববাবু। 

- প্রায়ই তুমি আমারই পাশে লেপ্টে থাকো। অথবা পাশের ঘর থেকে তোমার গুনগুন শুনতে পাই, বুঝি আমার হয়েই আছ। আর ঘুম ভেঙে তোমায় আশেপাশে না পেলে? তোমায় খুঁজতে বেরোই। কত জীবন প্রাণপণে খুঁজেও তোমার দেখা পাইনি।  কতবার এমনও হয়েছে তোমায় অন্য কারুর হয়ে থাকতে দেখেছি। চুরমার হই বটে কিন্তু জানি, বেশিদিন তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে না। কয়েক ঘুম দূরেই তুমি আছ। আমি ছাড়া তোমারও কোনও গতি নেই। কোনও নতুন দেশে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুম ভাঙবে, এ ভরসাটুকু তো থাকেই। 

- দেখুন বিপ্লববাবু। আপনি একটা আস্ত ফ্রড! আর রীতিমতো অসভ্য একজন মানুষ।

- এ জীবনে তুমি আমায় আগে দেখোনি। অথচ তোমার পিঠের ওই তিলের ত্রিভুজটার কথা আমি জানলাম কী করে?

- বেরিয়ে যান। এখুনি।

- প্লীজ রীতা। এ'বারে সাতসাতটা ঘুম পেরিয়ে তোমার দেখা পেয়েছি। তাও নিজের করে নয়। অমন ভাবে দূরে ঠেলে দিও না। 

- গেট আউট।

- আমাদের কত নাম রীতা। কত বাড়ি, কত জড়িয়ে ধরা মুহূর্ত।  কত রঙিন পৃথিবী আমরা ভাগ করে নিয়েছি।  এই পৃথিবীর একটা গান...আমাদের জন্য যে কী প্রবল ভাবে সত্যি। 'যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা'।

- বিপ্লববাবু, আপনি এখনই আমার চেম্বার থেকে বিদেয় না হলে আমি সিকিউরিটি ডেকে আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিতে বাধ্য হব।


***

- কী গো! ওঠো!

- উম!

- আরে আর কত ঘুমোবে। 

- পাশে এসো একটু।

- ন্যাকাপনা।  শনিবার তোমার অফিস ছুটি, আমার নয়। ওঠো এ'বার। 

- মিতুল, পাশে এসো না। প্লীজ।

- ধুস। এমন ভাব দেখাও মাঝেমধ্যে যেন সাতজন্ম পর দেখছ। গা জ্বলে যায়।

- তা প্রায় সাত জন্মই হবে। ইনফ্যাক্ট, গত জন্মে তুমি বড় নির্মম ভাবে আমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েছ।

- কী যে আজেবাজে সব গপ্প ফাঁদো তুমি মাঝেমধ্যে। ধেত্তেরি। 

- তুমি টেনিস খেলবে মিতুল?

- জীবনে র‍্যাকেট ধরিনি। আমার ওই লুডোই ভালো। 

- পিঠে তিলের ত্রিভুজ থাকলে টেনিসে গ্র‍্যান্ডস্ল্যাম লাভ হয়। লেগে পড়ো।

- তুমি একটা আস্ত পাগল। ঠিক আছে, ঘুমোও আরও।

- নাহ্, ভাবছি দিন তিনেক না ঘুমিয়ে থাকব। তোমায় জাপটে।

কবীরিয়ানি

$
0
0

- পুরস্কারটা পেয়ে কেমন লাগছে অপূর্ববাবু?

- কী বলব। এত বড় একটা সম্মান৷ সে'টাও মুখ্যমন্ত্রী নিজে আমার হাতে তুলে দিলেন। ভাবলেই এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

- মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আপনার নোবেল পাওয়া উচিৎ। আফটার অল, একটা গোটা রাজ্যের ভাগ্যপরিবর্তন ঘটেছে আপনার এই আবিষ্কারের হাত ধরে।

- আজ্ঞে..ইচ্ছেটা আমার মনেও যে ছিল না তা নয়। সুইটেবল ক্যাটেগরির অভাবে অ্যাপ্লিকেশনটা ফাইল করা গেলনা। যাকগে, বাংলার মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি৷ সে'টাই অনেক।

- শুনেছি গত সাতমাস ধরে ট্রায়াল চালিয়েছেন?

- প্যান্ডেমিকের বাজারে পাবলিক হেলথ নিয়ে তো আর ছেলেখেলা চলেনা। এই আবিষ্কার নিয়ে সাতটি স্তরে হিউম্যান ট্রায়্যাল চালিয়েছি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাকসেস রেট। একশোয় একশো।

- কবীরয়ানি নামটার পিছনে কোনও ইন্সপিরেশন? 

- ‘‘মায়ায় অন্ধ বসুন্ধরায় কেউ চেনেনা আমাকে। বাতাসও নই মাটিও নই, আমি শুধুই জ্ঞান। সবার ঊর্ধ্বে আমি শুধুই সুবাসের এক ফেরিওয়ালা’’। শুনেছেন তো?

- কবীরের দোঁহে?

- রাইট। তবে সামান্য ট্যুইস্ট করে চালাই৷ কবীর বলেছিলেন 'আমি শুধুই শব্দের এক ফেরিওয়ালা'। আমি বলি 'আমি শুধুই সুবাসের এক ফেরিওয়ালা'। কখন কোন ম্যাজিকে কাজ হয় তা কে বলতে পারে। কবীরে শব্দে কেল্লা ফতে করেছিলেন। আমি ফোকাস করেছি সুবাসে।

- আর সেই সুবাসে সমস্ত বাঙালি নিজের অসাবধানতা ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠল। বাজার করে নিকেশ হয়ে যাবে; এই বিশ্রী বদনাম উড়িয়ে দিয়ে এখন বাঙালি গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। পরিসংখ্যানও তাই বলছে, করোনার দাপট বেশ কমে এসেছে আপনার আবিষ্কৃত বিরিয়ানি ফ্লেভারের হ্যান্ডস্যানিটাইজার বাজারে আসার পর।

- কবীরিয়ানি তো শুধু সুগন্ধ নয়৷ এক্কেবারে আদত ফ্লেভার৷ কবীরিয়ানিতে হাত কচলে মুলোশাক মাখা ভাত খেলেও যে কারুর মগজ আচ্ছন্ন থাকবে খাঁটি কলকাতা বিরিয়ানি মার্কা ভালোবাসায়। আর সেখানেই মানুষ কনভিন্সড হয়েছেন, বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন কবীরিয়ানিকে। রোজ রোজ গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে, ঠেলাঠেলি করে ভালোমন্দ বাজার করার হ্যাপা নেই। টোটাল নিশ্চিন্দি। আমার এই হ্যান্ডস্যানিটাইজার হাত ডলে ভাতেভাত খেতে বসেও সবাই 'বহুত খুব, নাজুক'বলে টেবিল চাপড়াচ্ছেন। বাজারের ভীড় কমে যাওয়ার গোটা রাজ্যে এখন প্রবল ডিসিপ্লিন, তাই না?

- একদম। তাছাড়া, থ্যাঙ্কস টু ইওর আবিষ্কার, কারণে অকারণে অফিসে, রাস্তায়, বাড়ির সোফায়;  সবাই এখন মাঝেমধ্যেই কবীরিয়ানি বের করে হাত কয়েক ফোঁটা ঢেলে নিচ্ছে। এ'টাই মনভালো করার সবচেয়ে সহজ ফর্মুলা। অনেকে বলছেন যে মনে ফুরফুর আনতে আপনার এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার নাকি সিঙ্গল মল্টের চেয়েও বেশি এফেক্টিভ।

- হেহ্। হেহ্।

- ইফ আই মে আস্ক, শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নিজেও নাকি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন৷ 

- নিজের মুখে আর কী বলব বলুন। আমি পাতি মানুষ, সবার ভালোবাসায় এক্কেবারে ভেসে যাওয়ার উপক্রম। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন৷ নিরামিষ খাইয়েদের জন্য একটা নতুন স্যানিটাইজারের কথা ভেবেছি; ধোকলাইজার। অবিশ্যি সে'টার হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হতে এখনও দেরী আছে। তবে করোনায় কাবু এই অন্ধকার সময়ে; গোটা দেশে যদি ডিসিপ্লিন, স্বাস্থ্য সচেতনতা আর পরিতৃপ্তির একটা ঢেউ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, ক্ষতি কী বলুন?
Viewing all 1738 articles
Browse latest View live